সারা দেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাগামহীন চলাচল বর্তমানে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন এবং সরকারের নানা নির্দেশনার পরও এই যানবাহনের নিয়ন্ত্রণে সরকারের চরম ব্যর্থতা এখন সাধারণ মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সারা দেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার কারণে মোট ৮৭০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৮৭৫ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ৭৭৯ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্তেই ৩৭১টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৭৮ জন, আহত হয়েছেন ৭০৯ জন।
গতকাল রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে এই বিষয়টি আবারও সামনে চলে আসে। সেখানে এক অটোরিকশা মোটরসাইকেলকে ওভারটেক করতে গিয়ে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেলের দুই আরোহী ছিটকে পড়ে পেছন থেকে আসা একটি বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন।
এই দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মিজানুর রহমান বলেন, “বাইকটির গতি খুব বেশি ছিল না, তবে অটোরিকশার আচরণ ছিল বিপজ্জনক। ওভারটেক করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনে।”
এই একক ঘটনাই নয়, প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও অটোরিকশা-জনিত দুর্ঘটনায় মানুষ হতাহত হচ্ছে। অথচ, অধিকাংশ ঘটনা পুলিশের ডেটায় জায়গা পায় না, ফলে প্রকৃত চিত্রটি থেকে যায় আড়ালে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরই) তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের প্রথম ১০ মাসে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহনের কারণে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটে, যার ৫৮২টি ছিল মারাত্মক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সহায়তার অভাবে সঠিক তথ্য হালনাগাদ করা যাচ্ছে না।
এদিকে, দেশের চার হাজার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ মানুষ চিকিৎসা নেয়। অথচ গণমাধ্যমে এসব ঘটনার মাত্র ১০ শতাংশই প্রকাশ পায় বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন।
সরকারের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছোট যান হিসেবে গণ্য হওয়ায় এক বা দুইজন হতাহত হলে তা গুরুত্ব পায় না। কিন্তু বাস্তবে সারাদেশে এই বাহনের কারণেই প্রতিদিন হাজারো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”
দীর্ঘদিন ধরেই সড়কে অটোরিকশা নিষিদ্ধ করার দাবি উঠলেও সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও এ বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখাতে পারেনি।
ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে। অনেক সময় এই বাহনের পক্ষে এবং বিপক্ষে সংঘর্ষও হয়েছে। গুলশানে গুলশান সোসাইটির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অটোরিকশা চালানোর চেষ্টা করায় চালকদের সঙ্গে পথচারীদের মধ্যে দাঙ্গাও হয়েছে।
সবশেষে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নতুন নকশার নিরাপদ রিকশা বাজারে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল সমস্যা নতুন বাহন নয়, বরং বিদ্যমান অটোরিকশাগুলোর নীতিমালা, লাইসেন্স, প্রশিক্ষণ এবং রাস্তার উপযোগিতা বিবেচনায় না নেওয়ায় অনিয়ন্ত্রিত চলাচল অব্যাহত রয়েছে।
সরকার যদি এখনই কঠোরভাবে এই যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ না নেয়, তাহলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।