রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কারের মাধ্যমে রাজনীতির নতুন পরিবেশ তৈরির আকাঙ্ক্ষা থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সৃষ্টি হওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা থেকে জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।
রবিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, “অন্তর্বর্তী সরকার সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিকে নীতির কাঠামোয় আনার জন্য এবং রাজনীতির জন্য নতুন পরিবেশ সৃষ্টির নিবিড় আকাঙ্ক্ষা থেকে। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা থেকে জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।”
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ওই ভাষণে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে এ আহ্বান জানান তিনি।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর দায়িত্ব গ্রহণ করে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
দায়িত্বের ১০০ দিনে জুলাই-অগাস্টে কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতন আন্দোলনের সময় ‘নির্বিচারে হত্যার’ অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
পাশাপাশি মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এখন পর্যন্ত নির্বাচন আয়োজনের কোনো রূপরেখা না দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে আসছে, সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার পর জাতীয় নির্বাচন হবে।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ৩৪ মিনিটের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের রোডম্যাপ পাওয়ার জন্য ‘অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার’ কার্যক্রম শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত নই, সংস্কার প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের সুযোগ আমরা কতটুকু পাব। তবে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার কাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব।
“ততদিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ করব। আমরা চাইব, আমরা যেন এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারি যা যুগযুগ ধরে অনুসরণ করা হবে। এর ফলে সাংবাৎসরিক রাজনৈতিক সংকট থেকে আমাদের দেশ রক্ষা পাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু আমি আপনাদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি। নির্বাচনি সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত আপনারা নির্বাচনের রোডম্যাপও পেয়ে যাবেন।”
দৈনন্দিন রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি সরকারকে ‘ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বিনির্মাণের’ কথাও ভাবতে হচ্ছে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আপনারা সবাই জানেন, আমাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মধ্যদিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর।
“আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতামত নিয়ে যাচ্ছি। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এসব মতামত অনেকাংশে প্রতিফলিত হচ্ছে।”
তিনি বলেন, চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটি মতামত সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
“আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময়ে, ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করতে পারবে। তাদের সুপারিশ নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ক্রমাগতভাবে আলোচনায় বসব। সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমরা সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করব।”
তবে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো বলে আসছে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সংস্কারের দায়িত্ব মূলত পালন করবে রাজনৈতিক দলগুলো। দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের কথা বলার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও সময় দেওয়ার কথাও বলছে তারা।
সেই বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে ইউনূস বলেন, “নির্বাচন কবে হবে এই প্রশ্ন আপনাদের সবার মনেই আছে। আমাদের মনেও সারাক্ষণ আছে।
“আপনারা লক্ষ্য করেছেন নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। কয়েকদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে। তারপর থেকে নির্বাচন আয়োজন করার সমস্ত দায়িত্ব তাদের উপর বর্তাবে।”
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হাল নাগাদসহ আরও কিছু কাজ শুরু করে দিতে পারবে, যা একটি অবাধ নির্বাচনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রথমবারের মত প্রবাসী বাংলাদেশিরা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সে লক্ষ্যেও সরকার কাজ করছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিলেই নির্বাচন আয়োজনে সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় বলে তিনি মনে করেন না। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কারও এই সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে এই ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছে।
শুরুতে গঠন করা ছয় সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিভিন্ন গণমাধ্যমে আপনারা তাদের কার্যক্রমের আপডেটও দেখছেন। কয়েকটি সংস্কার কমিশন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছে। আমার অনুরোধ আপনারা এই প্ল্যাটফর্মে উৎসাহ সহকারে আপনাদের মতামত জানাতে থাকুন।”
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই কমিশনের সুপারিশমালা অত্যন্ত জরুরি। তাদের প্ল্যাটফর্মে যান। আপনার মতামত খোলাখুলিভাবে তুলে ধরুন। আপনি দেশের মালিক। আপনি বলে দিন আপনি কি চান। কীভাবে চান।
“নির্বাচন নিয়ে আপনাদের সকল বক্তব্য বিনাদ্বিধায় বলতে থাকুন। সবার মনের কথা তুলে ধরুন। আমার অনুরোধ সংস্কারের কথাটাও একই সঙ্গে বলুন।”
সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনের কথা বলার সঙ্গে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের কথাটিও বলুন।
“সংস্কার হল জাতির দীর্ঘমেয়াদি জীবনী শক্তি। সংস্কার জাতিকে বিশেষ করে আমাদের তরুণ-তরুণীদের নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সুযোগ দেবে। জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।”
সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিষয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচন আয়োজনে যে সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় রাজনৈতিক দলসমূহ এবং দেশের সকল মানুষের মতামত অপরিহার্য সে কমিশন হল সংবিধান সংস্কার কমিশন।
“এই সুপারিশমালার কোন অংশ সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তার ভিত্তিতে নির্বাচনি আইন সংশোধন করতে হবে। সমান্তরালভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে।”
‘নির্বাচনের ট্রেন আর থামবে না’
‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে’ বলে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলি কাজ সেরে ফেলতে হবে।
“এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তারজন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি আর তা হবে রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যমত্যের মাধ্যমে।”
এর মধ্যে অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে আলাপ চলতে থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচন ছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করার ব্যাপারে ঐক্যমত্য গঠনের জন্য অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হতে পারে।
“দেশবাসীর কাছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে আমরা ক্রমাগতভাবে প্রশ্ন তুলতে থাকতে থাকব-কী কী সংস্কার নির্বাচনের আগে আপনারা করে নিতে চান। নির্বাচনের আয়োজন চলাকালীন কিছু সংস্কার হতে পারে। সংস্কারের জন্য নির্বাচনকে কয়েক মাস বিলম্বিতও করা যেতে পারে।”
সংস্কারের ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ যাতে হাতছাড়া না হয়, সে বিষয়ে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা দু’দিন পরে চলে যাব।
“কিন্তু আমাদের মাধ্যমে জাতির জন্য যে ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হলো সে সুযোগটা যেন কোন রকমেই হাতছাড়া করে না দিই এটার ব্যাপারে দৃঢ় থাকার জন্য আমি দলমত, নারী-পুরুষ, ধর্ম, তরুণ-বৃদ্ধ, ছাত্র, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কৃষক নির্বিশেষে সবার কাছে আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করি আপনারা আমার এই আবেদন গ্রহণ করবেন।”
‘সরকারকে ব্যর্থ করার মহাপরিকল্পনা প্রতি মুহূর্তে কার্যকর’
অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য বিশাল অর্থের বিনিময়ে বিশ্বব্যাপী এবং দেশের প্রতিটি স্থানে ‘এক মহাপরিকল্পনা প্রতি মুহূ্র্তে কার্যকর’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান দেশবাসীর প্রতি জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এ সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য, অকার্যকর করার জন্য বিশাল অর্থে বিশ্বব্যাপী এবং দেশের প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এক মহাপরিকল্পনা প্রতি মুহূর্তে কার্যকর রয়েছে।
“তাদের একটি বড় প্রচেষ্টা হচ্ছে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। পতিত সরকারের নেতৃবৃন্দ যারা এদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে নিয়ে গেছে সে অর্থে বলিয়ান হয়ে তারা দেশে ফিরে আসার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।”
দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “তাদেরকে কিছুতেই সফল হতে দেবেন না। তারা সফল হওয়া মানে জাতির মৃত্যু। জাতি হিসেবে আমাদের অবসান। সাবধান থাকুন।
“তাদের সকল হীন প্রচেষ্টাকে আমাদের ঐক্যের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিন। যেভাবে নস্যাৎ করেছিলেন তাদের বন্দুকের গুলিকে। তাদের আয়না ঘরকে। প্রতি পায়ে তাদের অনাচারের শিকলকে। এ ব্যাপারে সবাই একমত থাকুন, ঐক্যবদ্ধ থাকুন।”
‘শেখ হাসিনাকেও ফেরত চাইব’
জুলাই-অগাস্ট গণআন্দোলনের সময়ে হত্যাকাণ্ডের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ জড়িত সবার বিচারের প্রতিশ্রুতি ভাষণে দেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলের গুম-খুনের বিচার নিশ্চিতের কথাও বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “প্রতিটি হত্যার বিচার আমরা করবই। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারের যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, তার কাজও বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও আমরা ভারত থেকে ফেরত চাইব।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিন অতিক্রম করলাম। আপনারা জানেন কি কঠিন এক পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে।
“ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব গণ অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান পালিয়ে গেলে দেশ সরকার-শূন্য হয় সাময়িকভাবে। পুলিশ প্রশাসন ও এসময় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে উদ্বেগজনক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।”
সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ‘স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত’ দেশকে পুনর্গঠন করতে হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “জুলাই-অগাস্ট বিপ্লবের পর আমরা এমন একটি দেশ হাতে পেয়েছি যার সর্বত্র ছিল বিশৃঙ্খলা।
“স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিপ্লব চলাকালে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-শ্রমিক জনতার শহীদি মৃত্যু হয়। আমাদের সরকার প্রতিটি মৃত্যুর তথ্য অত্যন্ত যত্নের সাথে জোগাড় করছে।”
ওই সময়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ আহত হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আহতদের জন্য ঢাকার ১৩টি হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
“প্রতিদিনই তালিকায় আরও নতুন নতুন শহীদের তথ্য যোগ হচ্ছে যারা স্বৈরাচারের আক্রোশের শিকার হয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।”
জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি ১৫ বছরে সব অপকর্মের বিচার করবেন মন্তব্য করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছে, খুন হয়েছে এই সময়ে। আমরা গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছি। কমিশন প্রধান আমাকে জানিয়েছেন অক্টোবর পর্যন্ত তারা ১ হাজার ৬০০ গুমের তথ্য পেয়েছেন। তাদের ধারণা এই সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে।”
সবাইকে দ্বিধাহীনভাবে অভিযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেকেই কমিশনের কাছে গুমের অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা তারা আবার আক্রান্ত হতে পারেন, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
“আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আপনারা দ্বিধাহীন চিত্তে কমিশনকে আপনাদের অভিযোগ জানান। কারো সাধ্য নেই আপনাদের গায়ে আবার হাত দেয়।”
গুম কমিশনের সদস্যদের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের ‘অত্যন্ত মর্মান্তিক’ বর্ণনা পাওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জুলাই-আগেস্টের বিপ্লবের পর ছাত্র-ছাত্রীরা শহর বন্দরের দেয়ালে- দেয়ালে তাদের মনের কথা লিখেছে।
“তাদেরও আগে যারা গুমের শিকার হয়েছে, প্রতিটি গোপন আস্তানার দেয়ালে- দেয়ালে তারা লিখে গেছেন রেখেছেন তাদের কষ্টের মর্মস্পর্শী বিবরণ। তাদের এসব কষ্টের কথা শুনে আমাদের হৃদয় কেঁপে উঠেছে।”
এসবের সঙ্গে জড়িতদের ‘বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবই’ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অভিযুক্ত যতই শক্তিশালী হোক, যে বাহিনীরই হোক তাকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
কেবল দেশে নয়, গুম, খুন ও জুলাই-আগস্ট গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের আন্তর্জাতিক আদালতেও বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান কৌঁসুলি করিম খানের সঙ্গে আমার এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে।”
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কোনো সদস্য কিংবা অন্য কেউ যাতে হত্যা, গুমসহ এ ধরনের কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য সরকার গুম বিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সাক্ষর করেছে।
আইনশৃঙ্খলা-দ্রব্যমূল্য
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টানা সাত দিন পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকার অবস্থা থেকে এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘দৃশ্যমান উন্নতি’ হওয়ার কথা বলছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।
তিনি বলেন, “পতিত স্বৈরাচার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মত ব্যবহার করেছে। বাধ্য হয়ে তাদের অনেকেই গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা জনরোষের শিকার হয়েছেন।
“এতে তাদের মনোবল অনেক কমে যায়। আমরা পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে এনে তাদের আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে অনেক দৃশ্যমান উন্নতিও হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও কিছু নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতিতে সহায়তা করেছে।”
কঠিন এই সময়ে ‘অপরিসীম ধৈর্য্যের’ পরিচয় দেওয়ায় জনগণকে এবং প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানোর রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ দেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “আপনাদের সবাই এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদী শক্তি ভয় দেখিয়েছিল তারা ক্ষমতা ছাড়লে দেশে লাখ লাখ লোক মারা পড়বে। টানা সাত দিন পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকার পরও ব্যাপক আকারে সহিংসতা এড়ানো গেছে।”
‘সম্পূর্ণ অরক্ষিত’ দেশে সংখ্যালঘুদের উপর ‘কয়েকটি ক্ষেত্রে’ সহিংসতার কথা স্বীকার করলেও এক্ষেত্রে ‘অতিরঞ্জিত’ প্রচার-প্রচারণা চলেছে অভিযোগ করেছেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “আমরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি, বাংলাদেশ তখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত একটা দেশ। এসময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
“কয়েকটি ক্ষেত্রে তারা সহিংসতারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু এটা নিয়ে যে-সব প্রচার-প্রচারণা হয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত।”
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “অল্প যে সমস্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। আপনাদের সবার সহযোগিতায় আমরা দৃঢ়ভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি।”
চলতি বছর দুর্গাপূজার সময় হওয়া সবগুলো সহিংসতার ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
দ্রব্যমূল্য বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “বন্যার ফলে অনেক জায়গায় ফসলহানি হয়েছে, ব্যাহত হয়েছে পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল। বন্যা পরবর্তী সময়ে বাজারে শাক-সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে আপনাদের কষ্ট হয়েছে।
“নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। বাজারে ডিমের সরবরাহ বাড়ানো জন্য আমরা সাড়ে নয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছি। এজন্য প্রয়োজনীয় শুল্ক ছাড়ও দেওয়া হয়েছে। মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ডিমের উৎপাদকরা যাতে সরাসরি বাজারে ডিম সরবরাহ করতে পারে সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “মানুষ যাতে স্বল্প মূল্যে কৃষি পণ্য কিনতে পারে সেজন্য রাজধানীসহ বিভিন্ন স্পটে সরকারি কিছু পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি নিম্ন আয়ের ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যে ৫৭ লাখকে স্মার্ট কার্ডে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
“বন্যার ফলে চালের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। আসন্ন রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ ও দাম যাতে স্বাভাবিক থাকে এজন্য সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “দ্রব্যমূল্য নিয়ে আমাদের কোনো লুকোছাপা নেই। মূল্যস্ফীতির পূর্ণ তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি রোধে উচ্চ সুদের হার নির্ধারণসহ একাধিক নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে শস্য আমদানিতে এলসি সীমা অপসারণ এবং সরবরাহ চেইন সংক্ষিপ্ত করা।
“সামান্য হলেও জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়েছে। শিল্প কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ব্যাহত না হয় এবং রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। গণ-শুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম না বাড়ানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা আশা করি বাজারে পণ্যমূল্য কমিয়ে আনতে এটা ভূমিকা রাখবে। নেপাল থেকে পানিবিদ্যুত বাংলাদেশে আনার ব্যবস্হা করা হয়েছে।”