BMBF News

আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকে পুঁজি করেই কি রাজনীতি করতে চায় এনসিপি?

গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির আত্মপ্রকাশের প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও দলটির নিজস্ব কোনো মতাদর্শ কিংবা নীতি স্পষ্টভাবে দেখা যায়নি।

বরং নানা প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার বিষয়গুলোই দলটির মূল এজেন্ডা হিসেবে সামনে এসেছে। একইসাথে এনসিপির দলীয় কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সহায়তা নিয়েও হচ্ছে নানা আলোচনা।

প্রশ্ন উঠছে, আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকে পুঁজি করেই দলটি তাদের রাজনীতি এগিয়ে নিতে চাইছে কিনা।

যদিও এমন অভিযোগ একেবারেই নাকচ করছেন দলটির নেতারা।

তাদের ভাষায়, আওয়ামী লীগের বিচার চাওয়া এনসিপির বর্তমান কর্মসূচির অংশ। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত করাই এনসিপির লক্ষ্য।

অবশ্য, কথার সঙ্গে দলটির নেতাদের কাজে মিল পাচ্ছেন না বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, একাধিক ঘটনায় আওয়ামী লীগ বিরোধিতার ওপর ভর করে এনিসিপির এগোনোর যে বিষয়টি দৃশ্যমান হচ্ছে, তা রাজনীতির মাঠে দলটির জন্য “হিতে বিপরীত” হবে।

জনসংযোগের জন্য পয়লা জুলাই থেকে দেশব্যাপী পদযাত্রা শুরু করে এনসিপি। তারই অংশ হিসেবে গত ১৬ই জুলাই গোপালগঞ্জে যাওয়ার ঘোষণা দেয় দলটি। তবে জেলাটির ক্ষেত্রে একই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’।

এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বেশ কিছু পোস্টও দেন এনসিপি নেতারা।

কর্মসূচির আগের দিন, অর্থাৎ ১৫ জুলাই এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজের ফেসবুক পেজে লেখেন, “আগামীকাল গোপালগঞ্জে স্লোগান হবে- মুজিববাদ মুর্দাবাদ”।

পরদিন সকাল থেকেই গোপালগঞ্জে উত্তেজনা দেখা গেলেও তারা সেখানে যান এবং মঞ্চে দাঁড়িয়ে মি. আব্দুল্লাহ আবারও বলেন, “মুজিববাদ মুর্দাবাদ”। তার সঙ্গে স্লোগান দেন অন্য নেতারাও।

একইদিন দুপুরে দলটির শ্রমিক উইংয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম ফয়সাল সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে লেখেন, “মৃত্যু অথবা মুজিব মাজার ভাঙা”।

১৫ মিনিট পর আরেকটি পোস্টেও তিনি গোপালগঞ্জে “মুজিববাদ মুর্দাবাদ” স্লোগান দেওয়ার বিষয়টি লিখেন।

যদিও এসব কর্মকাণ্ডকে দলীয় নয় বরং ব্যক্তিগত বক্তব্য বলেই জানান এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব।

তিনি বলেন, “মার্চ টু গোপালগঞ্জ বললেও এটা পথসভাই ছিল। নাম ভিন্ন ছিল আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। আমাদের পক্ষ থেকে টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়া কিংবা সেখানকার মাজার ভাঙার প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, উসকানি – কোনোটাই ছিল না।

অবশ্য দল গঠনের আগে ও পরে বিভিন্ন সময় এনসিপি নেতাদের এমন স্লোগান দিতে দেখা গেছে।

তবে ১৬ তারিখ আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান থাকা গোপালগঞ্জে যাওয়ার আগে দলটির নেতারা তাদের ভাষায় ‘মুজিববাদ’ নিয়ে যেভাবে সরব হন, মাসব্যাপী কর্মসূচির আগের ১৫ দিনে তা দেখা যায়নি।

সেদিন এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে গোপালগঞ্জে হামলা-সংঘর্ষে প্রথমে চার জন ও পরে আরও একজনসহ মোট পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটে।

পরদিন ফরিদপুরে পদযাত্রায়ও একই স্লোগান দেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

এর আগে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গত মে মাসে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও করে এনসিপি। পরে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

তারও আগে, দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে দুইদিন ধরে বুলডোজার দিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২’এ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাতেও সমর্থন দেন বর্তমান এনসিপি নেতারা।

এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকে পুঁজি করেই কি এনসিপি তাদের রাজনীতি এগিয়ে নিতে চাইছে?

এই প্রশ্নের জবাবে দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নিছক আওয়ামীবিরোধিতা বা আওয়ামী লীগের কাউন্টার করা, সেটাকে আর প্রয়োজনীয় রাজনীতি আমরা মনে করি না। বরং আওয়ামী লীগের বিচার হওয়াটাকেই আমরা আমাদের বর্তমান কর্মসূচির অংশ মনে করি”।

দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত করাই দলটির লক্ষ্য বলে জানান তিনি।

অনেকটা একই কথা বলছেন দলের জ্যেষ্ঠ্য যুগ্ম আহ্বায়ক সচিব আরিফুল ইসলাম আদীব। তার দাবি, “প্রাথমিকভাবে যেহেতু গত ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিবাদ হিসেবে আওয়ামী লীগ গুম, খুন হত্যা করেছে, বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়ন করেছে – এগুলোর জাস্টিস চাইতে গেলে বক্তব্যে অটোমেটিক আওয়ামী লীগ চলে আসে”।

তবে দলটির নেতাদের এসব কথাকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় স্বার্থে দলীয় কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে এখন পর্যন্ত তাদের বড় ধরনের সব কর্মকাণ্ডই “প্রধানত আওয়ামী বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে” হয়েছে বলে মত তাদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা এখনো এমন কোনো বক্তব্য নিয়ে আসতে পারেনি, যেটা দ্বারা মানুষ এনসিপির প্রতি আশাবাদী হতে পারে। তাদের দলের কর্মসূচি কী, তারা দেশের রাজনীতিকে কীভাবে সাজাতে চায়, অর্থনীতিকে কীভাবে সাজাতে চায়, সমাজনীতিকে কীভাবে সাজাতে চায় – এসবের বিষয়ে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার নয়”।

তারা কেবল “ফ্যাসিস্টবিরোধিতা আর আওয়ামী লীগ বিরোধীতার মধ্যে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

একই মত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধারও। তিনি বলছেন, সংস্কার বা নয়া বন্দোবস্তের কথা বললেও এখন পর্যন্ত দলটি একটি জায়গাতেই আটকে আছে।

“তাদের পুরো অফারিং করার ব্যাপারটা রাষ্ট্রগঠনের না হয়ে বারবার কোনো কিছু উপড়ানো, কিছু ভেঙে ফেলা- কখনো ৩২, কখনো মুজিববাদ – এদিকে তাদের মনোযোগ বেশি,” বলেন তিনি।

দল গঠন থেকে শুরু করে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনায় এনসিপি সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তা পাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যদিও তা কখনোই স্বীকার করেননি দলটির নেতারা।

যদিও দলটির পদযাত্রা কর্মসূচিতে সেই উদাহরণ দেখা গেছে একাধিকবার। গোপালগঞ্জে পরিস্থিতির অবনতির কথা জেনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর নিরাপত্তাবেষ্টিত হয়ে বুধবার এনসিপির শীর্ষ নেতারা সেখানে যান।

পরে হামলার মুখে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে গোপালগঞ্জ ছাড়েন তারা। এ নিয়ে বেশ কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে। পরদিন ফরিদপুরেও নিরাপত্তাবেষ্টিত হয়ে সভা-সমাবেশ করতে দেখা যায় এনসিপি নেতাদের।

“রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে সাথে নিয়ে আর যাই হোক জনসংযোগ হয় না। জনসংযোগ হয় মানুষের মনের গহীনে আপনি পৌঁছাতে পারেন কিনা”, বলেন মিজ স্নিগ্ধা।

“কিন্তু আমি এমন কোনো এজেন্ডা নিয়ে গেলাম যেখানে আমি একটা বিশৃঙ্খলা করতে চাচ্ছি, বিশৃঙ্খলাকে উসকে দিচ্ছি তাহলে সেটা সিম্পলি রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা”।

অবশ্য সমাবেশ করতে গিয়ে হামলার মুখে পড়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর সহায়তা নেওয়াকে দুর্বলতা মানতে নারাজ দলটির নেতারা।

দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের দাবি, ৩০টির বেশি জেলায় তাদের কর্মসূচি পালনের সময় তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তার প্রয়োজন হয়নি।

“কিন্তু যেখানে সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করছে, আমরা লাইফ থ্রেটের মধ্যে আছি – সেখানে আমাদের জীবন রক্ষা করা পুলিশ আর সরকারের দায়িত্ব”, বলেন তিনি।

যদিও কক্সবাজারেও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় হামলার মুখে একইভাবে সেনাবাহিনীর সহায়তায় কক্সবাজার ছাড়েন এনসিপি নেতারা।

এনিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, “আপনি যখন একজন শিক্ষার্থী, আপনি আপনার রাগ ক্ষোভ নানা ভাষায় ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু আপনি যখন একটা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বকারী তখন কিন্তু আপনার সংবরণ করাটা খুব জরুরি”।

এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে গোপালগঞ্জে সহিংসতা সত্ত্বেও আবারও সেখানে যাওয়ার কথা জানিয়েছে দলটি।

১৭ই জুলাই ফরিদপুরের কর্মসূচিতে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “এবার কিন্তু আমরা ফিরে আসার জন্য মার্চ করবো না। গোপালগঞ্জের মাটি ও জনগণকে মুজিববাদ থেকে সম্পূর্ণভাবে চিরতরে মুক্ত করে ফিরে আসবো”।

এরমাধ্যমে দলটি নিজেদের সাহস ও শক্তি প্রদর্শন করতে চাইলেও তা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ঘাটতি ও দুর্বলতার দিকেই ইঙ্গিত করছে বলে মত বিশ্লেষকদের।

তারা বলছেন, মতাদর্শিক জায়গা থেকে ভিত্তি প্রস্তর না করলে দল হিসেবে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে “মুজিববাদ বা ফ্যাসিবাদকে সরাতে হবে নতুন ডিসকোর্সের মাধ্যমে, যা এনসিপি সামনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে”।

অধ্যাপক সাব্বির আহমেদের মতে, কেবল অন্য দলের বিরোধী হিসেবে এনসিপি নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করলে তা যেমন সহিংসতার দিকে মোড় নেওয়ার সম্ভাবনা আছে, তেমনি দল হিসেবেও তারা “বেশি দূর এগোতে পারবে না”।

বরং তা “এনসিপির জন্য হিতে বিপরীত হবে” বলে মন্তব্য করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।