জুলাইয়ের পর যে জায়গাটা
নিয়ে সবচেয়ে কম ক্রিটিক্যাল আলাপ আমি দেখি, তা হলো অর্থনীতি। প্রায় শূন্য। জুলাই বাংলাদেশের মানুষকে যে মাল্টিডাইমেনশনালি ডিজাস্টার থেকে রক্ষা করেছে তার একটা দিক হলো, জুলাই না আসলে বাংলাদেশে একটা দুর্ভিক্ষ অবধারিত ছিলো।
আসেন কিছু জিনিস মনে করায়া দেই।
২০২৩ এর গরমকাল অনেকেই ভুলে গিয়েছেন। অথচ সেই গরমে লোড শেডিং এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে, কাইন্ড অব পুরো বাংলাদেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। কেন এরকম লোড শেডিং হয়েছিলো মনে আছে কারো? চাহিদার চেয়ে বেশি থাকা ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটির একটা দেশে এই সিচুয়েশন কিভাবে হলো? কারন দুর্নীতির এপিটোম কুইক রেন্টালগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ফুয়েল কেনার মত ডলার আমাদের হাতে ছিলো না। কেন ছিলো না? কারন ১৫ বছর ধরে কল্পনাতীত লুটপাটের ফলে রিজার্ভ বইলা কোন কিছুর আর অস্তিত্ত্ব ছিলো না। ডলার যা আসে তার চেয়ে বেশি (ফরেন লোন সহ) জাস্ট পাচার হয়ে যায়। দুই নম্বর যন্ত্রপাতি এনে নামকাওয়াস্তে প্ল্যান্ট বানায়ে তুঘলকি ক্যাপাসিটি চার্জের সেই লুটপাট, পুরো বিশ্বে এটার সাথে তুলনীয় কোন লুটপাটের এক্সাম্পল আপনি পাবেন না। ঐ যে ইন্সটল্ড আর জেনারেশন ক্যাপাসিটির যে হিসাব দেয়া হতো, সেটাও ছিলো জাস্ট বাটপারি। সেসব টেকনিক্যাল দিকে না যাই। বাই দ্যা ওয়ে, মাসে একবার করে ইলেক্ট্রিসিটির দাম বাড়তো, মনে আছে?
আপনারা ভুলে গেছেন, ২০২১ সাল থেকে কোন লেভেলের বিপর্যয়ে বাংলাদেশের সব ম্যানুফাকচারিং কোম্পানি, যারা প্রোডাকশনের জন্য র ম্যাটেরিয়াল ইম্পোর্ট করতো তারা পড়েছিলো। মনে নাই? যদিও এটা আসলে শুরু হয়ে গিয়েছিলো ২০১৯ থেকেই। কি ছিলো সেই বিপর্যয়? আমাদের ব্যাংকে ডলার নাই। কাজেই এলসি খোলা যাচ্ছিলো না। সে কি হাহাকার। একদিকে ব্যাংকে ডলার নাই, অন্যদিকে লুটপাট চলতেছেই, ক্রমাগত আমাদের রেটিং নামতেছে বিশ্বজুড়ে। কারন বিশ্ব জুইড়া যেসব সংস্থা অর্থনীতির খোঁজ খবর রাখে তারা সবাই জানে, বাংলাদেশরে আবারো তলা বিহীন ঝুড়ি বানানো হইছে। তারা সবাইরে তাদের সিস্টেমে সতর্ক করে দিলো, এই দেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করলে তোমাদের পাওনা টাকা রিস্কে পড়বে। ফলাফল দাঁড়ালো, বাংলাদেশ থেকে কেউ আর এলসি নিতে চায় না। কারন পেমেন্টের অনিশ্চয়তা। যে বা যারা এলসি নেয়, এট কনফার্মেশন চার্জ মাস্ট, যেটা কিনা আগে খুবই খুবই রেয়ার ছিলো। আমি নিজে ১০০টার মধ্যে ১০০ টা এলসিতেই কখনো এটা কনফার্মেশন চার্জ দিতাম না, বেশিরভাগ সাপ্লায়ার চাইতোই না। কারন এই এট কনফার্মেশন চার্জ ফাইনালি প্রডাকশন কস্টে যেয়েই হিট করবে। যাই হোক, কিছুদিন পরে এট কনফার্মেশন চার্জ দিলেও তারা এলসি নেয়া অফ করে দিলো। বাংলাদেশের হাতে গোণা কিছু ব্যাংক ছাড়া অন্যগুলো থেকে আর এলসি নেবে না বাইরের দেশের কোম্পানিগুলো, অবস্থা সেখানে গিয়েছিলো। এদিকে সরকারও শো অফ রিজার্ভ দেখানোর জন্য রিয়েল ব্যবসায়ীদের এই ধরনের এলসি খোলাও আরো কঠিন করে দিলো। যদিও আওয়ামীলিগারদের টাকা পাচার চলতেছিলো দেদারসে। ২০২২-২০২৩ এ এটা এমন অবস্থায় গেলো যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একচুয়ালি তখন থেকেই শ্রিঙ্ক করতেছে।
ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টের জন্য মেইন মেশিনারিজ কেনার সময় ব্যাপক ভাবে ডেফার্ড পেমেন্টের এলসি করা হতো। এটার সহজ মানে হলো, যে আমারে প্রডাক্ট পাঠাচ্ছে সে তার পেমেন্ট সাথে সাথেই পাবে, কিন্তু আমার ব্যাংক (মানে যেখান থেকে আমার এলসি যাচ্ছে), সে এই পেমেন্ট পাবে ১৮০ দিন বা ৩৬০ দিন পরে বিশেষত লোনটা যদি সেই ব্যাংক হয়ে আসে। বড় কোম্পানিগুলো এক্সপানশনের ক্ষেত্রে এটার ব্যাপক ব্যবহার করে। কারন ঐ ৬ মাস বা ১ বছর গ্রেস পিরিয়ডটা অসম্ভব জরুরী, যাতে করে ঐ সময়ের মধ্যে অন্তত প্রডাকশন শুরু করা যায়। অর্থাৎ ম্যানুফাকচারিং ইউনিট বানানোর যে আইডিয়াল টাইম (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন) সেই টাইমে বসে বসে ব্যাংককে যাতে টাকা না দেয়া লাগে। এই ডেফার্ড পেমেন্টের এলসি টার্মে সাপ্লায়ারকে রাজি করাতে কিছুটা ইফোর্ট দেয়া লাগতো। কারন অনেকেই এটা বুঝতো না যে তার কোন ইস্যু নাই এখানে। যদিও ফাইনালি রাজি হতো সবাই। কিন্তু ২০১৯ এর পর থেকে আস্তে আস্তে এটা নিয়ে ক্যাঁচাল শুরু হলো। এলসির টার্মস এন্ড কন্ডিশনে এই ক্লজ থাকলেই অনেকে একদম স্ট্রিক্ট না করে দেয়া শুরু করলো। ২০২১ থেকে তো অবস্থা আরো খারাপ হলো। কারন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ইউনিটগুলোর সবার কাছে হিসাব একটাই, বাংলাদেশ দেউলিয়া প্রায় অর্থনীতির দেশ। ওরা ওসব বা*লের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল দেখে না। ওরা প্রফেশনাল এজেন্সিগুলোর থেকে ইকোনোমিক ইন্টেল নেয়, জানে, বুঝে। আর এসবে তখন আর দরকারও ছিলো না। সব ততদিনে ফকফকা। কাজেই দিনের পর দিন বাংলাদেশের জন্য এলসির ক্লজগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগলো সারা দুনিয়া থেকে।
এভাবে সব দিকে সব বন্ধ হওয়াতে নতুন ইনভেস্টমেন্ট, এক্সপানশন সব প্রায় বন্ধ হতে থাকলো। একদিকে হাসিনা ও তার লোকজন ডলার পাচার করেই যাচ্ছে, অন্যদিকে এলসির কড়াকড়ি তখন ভোগ্যপণ্য আমদানির উপরেও চলছে। কারন নিজেদের ডলার পাচার অব্যাহত রেখে দেশের মানুষকে জয় বাংলা করে দিয়ে শো অফ রিজার্ভ দেখাতে চায় সরকার। একদিকে ভোগ্যপণ্য আমদানির উপর কড়াকড়ি, অন্যদিকে সেই আমদানির ব্যবসার প্রায় পুরোটাই আবার জাস্ট কয়েকটা আওয়ামী অলিগার্ক কোম্পানির হাতে। ফলাফল দাঁড়ালো, জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। ওএমএসের ট্রাকের উপরে পড়ে থাকা কিছু চাল, রাস্তায় পড়ে থাকা চাল…এসব কুড়ানোর সেই ছবিগুলো মনে আছে?
বাংলাদেশ খাদ্যের জন্য ব্যাপক ভাবে আমদানি নির্ভর দেশ। এমনকি যে কিছু ধান আমরা উৎপাদন করি, সেটার জন্য যে সার লাগে সেই সার ও প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। সারের আমদানি ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হলো এই ডলার না থাকার বিপর্যয়ে।একদিকে সার নাই, অন্যদিকে বিদ্যুৎ নাই বলে ক্ষেতে সেচ দেয়ার উপায় নাই। নিজে ডিজেল কিনে কিছু চালাবেন? পারলে প্রতিদিন তখন দাম বাড়াচ্ছে বেপরোয়া হাসিনা। তারপরেও সাপ্লাই নাই জ্বালানি তেলের। দুই একজন একটু ভয়ে ভয়ে বললো, এভাবে চললে চাল উৎপাদনে বিপর্যয় আসবে। কিন্তু বললো না, আমরা একটা দুর্ভিক্ষ থেকে জাস্ট এক দাগ দূরে আছি।
আরেকটা ব্যাপার বলি। ইন্টেরিম এসে এখন পর্যন্ত বিদেশি জ্বালানী কোম্পানিগুলোকে বকেয়া কত পরিশোধ করছে বলেন তো? প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার! এই বকেয়া হাসিনার রেখে যাওয়া। বিদেশি জ্বালানী কোম্পানির কাছে বকেয়া থাকার ফলাফল ভয়াবহ। আপনার টাকা বাকি থাকলে, পর্যাপ্ত নতুন জ্বালানি তো কিনতে পারবেনই না, সাথে সেই বকেয়া টাকার উপর নানা রকম জরিমানা (সুদ সহ অনেক কিছু) কম্পাউন্ড সিস্টেমে এড হতে থাকে। নট অনলি দ্যাট, যখন আপনি বাকিতে জ্বালানি কেনা ফকিন্নি দেশে পরিণত হন, তখন নতুন লটের জ্বালানি কেনার সময় নূন্যতম কোন দরদামের সুযোগ আর আপনাকে দেয়া হয় না। হায়েস্ট প্রাইস ধরে জ্বালানি দেয়া হয় কারন তারা জানে আপনি সময়মত টাকা দিবেন না। কাজেই নিলে নেন, না নিলে নাই। বাংলাদেশ এই চক্রে ঢুকে পড়েছিলো। মানে যত বকেয়া রাখবেন, তত আরো বাড়তে থাকবে বিপর্যয়। ইন্টেরিম এসে ডেস্পারেটলি এই চক্র থেকে বাংলাদেশকে বের করেছে। বাংলাদেশ বহু বছর পর আবার কম্পিটেটিভ প্রাইসে জ্বালানি কিনতেছে।
আসেন সব আবার একটু একসাথে দেখি। ব্যাপারটা হলো, কল্পনাতীত লুটপাটের কারনে আপনার ব্যাংকে আর ডলার নাই। যা আসে তাও লুট হয়েই যাচ্ছে। কাজেই আপনি না পারতেছেন নতুন ব্যবসা বাড়াতে, না পারতেছেন আগের ঋণ শোধ করতে, না পারতেছেন খাদ্য দ্রব্য সহ অতি জরুরী জ্বালানি, সার এসব আমদানি করতে। আবার যেহেতু নতুন ব্যবসা বাড়াতে পারছেন না কাজেই কর্মসংস্থান নাই। নতুন কর্মসংস্থান দূরে থাক র ম্যাটেরিয়ালস, জ্বালানির অভাবে রানিং ম্যানুফাকচারিং ফ্যাক্টরিগুলোও চলতে পারছে না। অর্থাৎ আপনার অর্থনীতি ফ্রিজ হচ্ছে। অন্যদিকে ভোগ্য পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ সহ প্রধান খাদ্য পণ্য উৎপাদনের যে সাপ্লাই চেইন তা ভেঙ্গে পড়তেছে। আবার আমদানি যা হয়, তাও এস আলম সহ কয়েকটা আওয়ামী অলিগার্কের হাতে সব। কাজেই সব কিছুর দাম আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। মানুষের পারচেজিং ক্যাপাসিটি নামতেছে মাটিতে, দ্রব্য মূল্য সহ একচুয়ালি পন্যের এভেলেইবেলিটির সংকট উঠতেছে আকাশে। ফলাফল? দুর্ভিক্ষ।
সেই হুবহু মুজিবের আমলের মতই। মুজিবের আমলে সবচেয়ে কনজার্ভেটিভ হিসেবেও দুর্ভিক্ষে ১০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলো বলে ধরা হয়। এবার কত হতো সংখ্যাটা? ভাবতে চাই না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন।
হাসিনা ১৫ বছর ধরে যে ফা**কড আপ করছে আমাদের অর্থনীতির, একমাত্র উপরওয়ালাই জানে, বাংলাদেশের কয়টা প্রজন্মরে এই দায় শোধ করা লাগবে। অন্তত আমি জানি না, আগামী এক দশকেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা।
আল্লাহ আমাদেরকে দুর্ভিক্ষের মত আজাব থেকে রক্ষা করছেন জুলাইয়ের শহীদদের বিনিময়ে। বাকি কাজ আমাদের দায়িত্ব এখন। ইন্টেরিম অর্থনীতিতে আসলেই খুব খুব ভালো কিছু কাজ করেছে। বিশেষ করে গত রমজানে ভোগ্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অলিগার্ক নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়ার কাজটা রিমার্কেবল ছিলো। হাসিনা যা করেছে, সেখান থেকে উঠে এসে এক বছরে অর্থনীতি দৌঁড়াবে এটা অসম্ভব, অবাস্তব। সামনে কি হবে জানি না। তবে ইন্টেরিম আইসিইউতে থাকা অর্থনীতিকে আপাতত কেবিনে এনেছে। কিন্তু তার মানে এই না যে, অর্থনীতি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার ধারেকাছেও এখনো আছে। একদমই না।