BMBF News

ঢাকার আকাশে সামরিক বিমান, শহরে ঘাঁটি ও বিমানবন্দর থাকার ঝুঁকি কী?

নিখোঁজ কন্যার খোঁজে মাইলস্টোন স্কুলের ভেতরে রাবেয়া খাতুন যখন কাঁদছিলেন, তখন স্কুলের ওপর দিয়েই একের পর এক বিমান উড়ে যাচ্ছিলো কাছেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে।

“এভাবে যে বিমান স্কুলের উপরে পড়বে কে জানতো? আমার মেয়ে কোথায়? আমাকে একটু ভেতরে যেতে দাও। আমি তো মেয়েকে পাচ্ছি না। আমি একটু ভেতরে গিয়ে দেখবো,” বিলাপ করে স্বেচ্ছ্বাসেবকদের অনুরোধ করছিলেন রাবেয়া খাতুন।

সোমবার বিমান বিধ্বস্তের পরদিন মঙ্গলবারও সন্তানের খোঁজ না পাওয়ায় স্কুলে এসেছিলেন তিনি। তার মেয়ের নাম রাইসা মনি, পড়তো তৃতীয় শ্রেণিতে।

রাবেয়া খাতুন শেষপর্যন্ত তার সন্তানের খোঁজ পান বৃহস্পতিবার।

মর্গে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের ডিএনএ পরীক্ষার পর রাবেয়া খাতুনের মেয়ে রাইসা মনির পরিচয় শনাক্ত হয় সেদিন।

একইদিনে ডিএনএ পরীক্ষার পর আগুনে পোড়া আরও চার মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করে সিআইডি।

এই পুরো ঘটনায় হতাহতদের অধিকাংশই শিশু হওয়ায় এই ঘটনা আরও বেশি আলোড়ন তুলেছে। শোক ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, বিদেশি গণমাধ্যমেও ঘটনাটি গুরুত্ব পেয়েছে।

আবার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকে ক্ষুব্ধও হন। স্কুলের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।

নিহতের সংখ্যা নিয়েও নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মরদেহ ‘লুকিয়ে ফেলা হয়েছে’ এমন অভিযোগে বিক্ষোভও হতে দেখা যায়।

কিন্তু এসবের মধ্যেও কিছু প্রশ্ন উঠেছে সবখানে। ঢাকার মধ্যে বিমানবন্দর রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত? কিংবা জনবহুল এলাকায় সামরিক বিমানের প্রশিক্ষণ হওয়া উচিত কি-না?

‘বিমান ঘাঁটি ঢাকায়, রানওয়ে তো একটাই’
পাকিস্তান আমলে ঢাকার বিমানবন্দর ছিল তেজগাঁওয়ে। পরে এটি শহরের বাইরে আনতে কুর্মিটোলায় আনা হয়। সেখানে বিমানবাহিনীর ঘাঁটিও আছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একমাত্র রানওয়ে হওয়ায় এটি সামরিক-বেসামরিক উভয় বিমানের উড্ডয়নের জন্যই ব্যবহৃত হয়।

এমনকি বেসামরিক হেলিকপ্টারও ব্যবহার করে এই এয়ারপোর্ট।

তবে সামরিক প্রশিক্ষণ ঢাকার আকাশে হয় না বলেই জানাচ্ছেন বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী। বিমান বাহিনীর যে প্রশিক্ষণ এলাকা সেটা ঢাকার বাইরে অবিস্থত বলে তিনি জানান।

“ঘাটাইল, টাঙ্গাইল, মধুপুর, শ্রীপুর – অর্থাৎ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর -এই যে এলাকা সেটা হচ্ছে ডেজিগনেটেড ফ্লাইং ট্রেনিং এরিয়া। যে এয়ারক্রাফট উড়েছে নিয়ম হচ্ছে, সেটা টেকঅফ করবে। এরপর বামদিকে টার্ন করে মিরপুর হয়ে যাবে,” বলেন মি. চৌধুরী।

তিনি বলেন, “কিন্তু বিমান ঘাঁটি তো ঢাকায় এবং রানওয়ে তো একটাই। ফলে এখান থেকেই সামরিক বিমানগুলোকে উড়তে হয়। তবে প্রশিক্ষণ এলাকা কিন্তু বাইরে।”

ঢাকার তেজগাঁওয়ের দাইনোদ্দা নামক স্থানে প্রথম একটি বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে ১৯৪১ সালে। সেই একই সময় কুর্মিটোলার বালুরঘাটে একটি ল্যান্ডিং স্ট্রিপ নির্মাণও শুরু হয়।

তেজগাঁও ও কুর্মিটোলার এয়ার স্ট্রিপগুলোতে সামরিক ফাইটার প্লেন অবতরণের সুবিধা ছিল এবং ব্রিটিশ বিমান বাহিনী তাদের বিমানকে নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই দুটো এলাকা ব্যবহার করেছিলো সেসময়।

পরে তেজগাঁও বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ট্রাফিক ব্যবস্থার জন্য আপগ্রেড করা হয়। পাকিস্তান আমলে এটাই বিমানবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলো।

কিন্তু এই বিমানবন্দরটি একটি আধুনিক ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং শহরের বাইরে বিমানবন্দর সরিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে ঢাকার কুর্মিটোলায় একটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এই কাজে ফরাসি বিশেষজ্ঞদের কারিগরি সহায়তায় নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয় গত শতকের ষাটের দশকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালে বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং অপারেশনাল কার্যক্রম তেজগাঁও থেকে কুর্মিটোলায় চলে আসে।

কুর্মিটোলা এলাকায় যখন বিমানবন্দরের কাজ শুরু হয় তখন এলাকাটি জনবহুল ছিল না।

কিন্তু পরবর্তীকালে বিমানবন্দরের চতুর্দিকে নানারকম ভবন গড়ে উঠতে শুরু করে। বহুতল ভবন, বসতবাড়ি, হোটেল, স্কুল,কলেজ, হাসপাতাল এমনকি গার্মেন্টসও গড়ে ওঠে।

ফলে ভবিষ্যতের ঝুঁকি এড়াতে বিমানবন্দর সরিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছেন না এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদ উল আলম।

তিনি বলেন, “শহরের মাঝখানে যদি এরকম একটা এয়ারপোর্ট রাখা হয়, তাহলে কিন্তু এটা সবক্ষেত্রেই আমাদের জন্য বিপদজনক।”

কিন্তু বিপদটা কত বড়?

মি. আলম বলেন, “উদাহরণ হিসেবে ধরেন, আল্লাহ না করুক, এখন যদি একটা যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক বিমান যদি এখানে পতিত হতো তাহলে চিন্তা করতে হবে যে সেটা কী ধরনের ধ্বংসাত্মক হতে পারে আমাদের জন্য। বিমানে যারা থাকবে তাদের জীবনহানির আশঙ্কা তো থাকেই। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে যেসব স্থাপনা থাকবে সেগুলোও তো ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। বিমানে যে তেল থাকে সেটা যদি বিস্ফোরিত হয় তাহলে পুরো পেরিফেরিতে একটা বিপর্যয় হবে। এই বিষয়গুলো কিন্তু আমরা কখনই চিন্তা করি না।”

কিন্তু তাহলে বিমানঘাঁটির কী হবে?

বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন অবশ্য বলছেন, কৌশলগত কারণেই এই বিমানঘাটির প্রয়োজন আছে।

সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি।

“বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে একটা জায়গা খুঁজে বের করলে পাশে আবার ঘনবসতি হয়। এখানে যখন বিমানবন্দর হয়েছিলো, আমি ১৯৮৫ সালে ফ্লাই করেছিলাম। তখন উত্তরা বলতে কিছুই ছিল না। এখন আপনি দেখেন কী অবস্থা। এখন এই দুর্ঘটনা একটা বিরল ঘটনা। এটার সঙ্গে ঘনবসতির সঙ্গে সম্পর্কিত করাটা ঠিক নয়। আমাদের দেশ ছোট, সবজায়গাতেই মানুষ,” বলেন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন।

তিনি বলেন, “এটা আমাদের মেইন বেইজ। সমস্ত ভিআইপিরা ঢাকায় থাকেন। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো এখানে আছে। সংসদ এখানে আছে। ফলে এগুলোর একটা প্রটেকশনের ব্যাপার আছে। ফলে এখানে এই ধরণের একটা স্ট্রং এয়ার বেইজ থাকা খুবই দরকার।”

পুরনো সামরিক বিমান কেন প্রশিক্ষণে?
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি এফটি-সেভেন (FT-7) যুদ্ধবিমান বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর– আইএসপিআর।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে জানান, বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি এফ-সেভেন ফাইটার প্লেনের ট্রেনিং ভার্সন হতে পারে।

এফ-সেভেন মূলত রাশিয়ার মিগ- টোয়েন্টিওয়ান (MiG-21) নামের একটি পুরনো যুদ্ধবিমানের চীনা সংস্করণ।

এই মডেলের বিমান প্রথমবার ১৯৬৬ সালে আকাশে উড়েছিল। ১৯৬৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২,৪০০-এরও বেশি এফ-সেভেন বিমান তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ, চীন ও উত্তর কোরিয়া—এই তিনটি দেশ এফ-সেভেন বিমান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে।

তবে মাইলস্টোন স্কুলে বিমান আছড়ে পড়ার পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, প্রশিক্ষণের কাজে বেশ পুরনো মডেলের এসব বিমানের ব্যবহার নিয়ে। কারণ চীনে তৈরি এসব বিমানের উৎপাদন এখন খোদ চীনেই বন্ধ হয়ে গেছে।

তবে বিমান বাহিনী প্রধান বলছেন, প্রযুক্তি পুরনো হলেও বিমানগুলো পুরোনো নয়।

“বিমান সাধারণত সহজে পুরোনো হয় না। প্রত্যেকটা বিমানের একটা লাইফটাইম আছে। এই বিমানগুলো প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত লাইফ থাকে। এখানে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে কি-না। প্রযুক্তিগতভাবে পুরোনো হয়েছে। কিন্তু বিমান পুরোনো নয়।”

তিনি বলেন, “এখন আমরা নতুন প্রযুক্তির বিমান জন্য অবশ্যই আমরা চেষ্টা করছি। আমরা ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির বিমান আনবো। কিন্তু তার মানে এই না যে সেটায় দুর্ঘটনা হবে না, এটা হতেই পারে।”

“আপনি উন্নত বিশ্বেও দেখবেন, অত্যাধুনিক যে বিমান আছে সেগুলোও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। কিছুদিন আগে এফ-থার্টি ফাইভের মতো জঙ্গি বিমানও দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। তবে আমরা অবশ্য এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নেবো এবং ভবিষ্যতে এটার প্রতিকার করবো।”