মেহেদী হাসান, দুমকী (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি:
অসুস্থ স্বামী, তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনা ও ভরনপোষন আর বৃদ্ধা শাশুরীকে নিয়ে অভাবের সংসারে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ইরানী বেগম। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না ঐ মুহুর্তে কি করবেন তিনি। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থায় পড়ে যান তিনি। অদম্য ইচ্ছা আর প্রবল মনোবল নিয়ে নিজের পতিত অনাবাদি জমিতে শুরু করেন শাক-সবজি চাষ। মাত্র ২’বছরে নিরলস পরিশ্রমে ঘুরে দাড়ান ইরানী আক্তার। এখন তিনি একজন সফল নারী কৃষি উদ্যোক্তা।
পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের জামলা গ্রামের আঃ মন্নানের স্ত্রী মোসাঃ ইরানী আক্তার করোনা কালীন সময়ে সংসারের অভাব অনটনের কথা চিন্তা করে মাত্র ২৪ শতাংশ জমিতে মাদা তৈরি করে শুরু করেন হরেক রকমের শাক-সবজির আবাদ। পর্যায়ক্রমে উপজেলা যুব উন্নয়ন ও কৃষি দফতরের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন শাক-সবজি, হাঁসমুরগি, মৎস্য চাষ, ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি ও তৈল জাতীয় ফসলের চাষাবাদ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি নিজের পতিত অনাবাদি জমিতে গড়ে তুলেছেন সবজি, হাঁসমুরগি ও মৎস্য চাষাবাদের জন্য সমন্বিত খামার।
এসকল প্রকল্পে ইরানী আক্তার উপজেলা যুব উন্নয়ন দপ্তর থেকে প্রথমে ৫০হাজার টাকা এবং পরে দেড়লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে সফলতার সাথে ৪০ শতাংশ জমিতে মাছের ঘের, দেশি জাতের হাঁস মুরগি, বাগানে বিভিন্ন জাতের শাক-সবজির চাষাবাদ করে বাজারে বিক্রি করে সংসারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইরানী আক্তারের সবজি বাগানে বিভিন্ন জাতের পেঁপে, লাউ,কুমড়া, ধূন্দল, করলা,ডাটা, কলমি,পাট, বরবটিসহ বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজির সমারোহ। মাঝখানে পুকুরে চাষ করেছেন বিভিন্ন কার্প জাতীয় মাছ। পুকুরের এককোণে ঘরে হাঁস মুরগি পালন করেছে। অপরদিকে নিজে উৎপাদন করেছেন ভার্মি কম্পোস্ট সার।
ইরানী আক্তার বাংলাদেশ সমাচার’কে বলেন, দু’বছর আগে অসুস্থ স্বামী, তিন ছেলেমেয়ে আর বৃদ্ধা শাশুরীকে নিয়ে অভাবের অনটনে দিনযাপন করছিলাম। হঠাৎ নিজের চিন্তা চেতনা নিয়ে নেমে পড়লাম নিজের পতিত অনাবাদি জমিতে খলা ও মাদা তৈরি করে লাউ,কুমড়া, পেঁপে সহ বিভিন্ন মৌসুমী শাক-সবজি চাষে। ভালোই লাভজনক দেখে উপজেলা যুব উন্নয়ন দপ্তর ও কৃষি অফিসের পরামর্শ, উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ এবং পরে ঋন নিয়ে বর্তমানে আমি ৪০ শতাংশ জমিতে সমন্বিত শাক-সবজি বাগান,মাছ ও হাঁসমুরগির খামার গড়ে তুলি। আমার বাগানে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে নিজের তৈরি জৈব ও ভার্মি কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করি। নিজের তৈরি নানা ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করি। আমার উৎপাদিত সবধরনের শাক-সবজি বিষমুক্ত, তাই পাড়া প্রতিবেশীরা সহ পাইকারি ক্রেতারা এখান থেকে বেশিরভাগ কিনে নেয়।
আমার বাগান থেকে প্রতিমাসে ২৫থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। তিনি আরো বলেন, গত রমজান মাসে শুধু পাকা পেঁপে বিক্রি করেছি ৫০হাজার টাকার, এছাড়াও বর্তমানে প্রতিকেজি পেঁপে ৩০টাকা, প্রতিটি লাউ ৫০-৭০ টাকা, কুমড়া ২৫টাকা, করলা ৫০ টাকা, ধুন্দুল ২৫ টাকা, শশা ৩০টাকা, চিচিঙ্গা ৩০টাকা দরে বিক্রি করছি। এছাড়াও বর্তমানে উন্নত জাতের ডাটা,পাট ও কলমি শাক বিক্রি করছি।
এখন আমার সংসারে অভাব নেই, তিন ছেলেমেয়ে স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়াচ্ছি, স্বামীও বর্তমানে অনেকটা সুস্থ হয়েছে।
এব্যাপারে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ ফারুক হোসেন বলেন, ইরানী আক্তার একজন কর্ম-তৎপর নারী উদ্যোক্তা। তার সমন্বিত খামার কয়েক বার পরিদর্শন করেছি এবং আমার উর্ধ্বতন পটুয়াখালী জেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ আঃ রশিদ তার প্রকল্প পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমরা তার খামারটি মডেল হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করেছি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ইমরান হোসেন বলেন, ইরানী আক্তারের সবজি, হাঁসমুরগি ও মৎস্য এবং তৈল জাতীয় ফসল উৎপাদন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশ গ্রহণ করে কৃষি ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, তরুণ প্রতিভাবান ইরানী আক্তারের খামার পরিদর্শন করেছি, তার ঘেরে সফলতার সাথে কার্পজাতীয় বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করেছেন।