ঢাকার উত্তরায় একটি উৎসবের আয়োজন বাধার মুখে পণ্ড হওয়ার একদিনের মধ্যে একই কারণে স্থগিত হয়েছে ‘ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব’। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে বাধার মুখে বন্ধ হয়ে যায় এই নাট্য উৎসব।
এর একদিন আগে বসন্ত উৎসবের আয়োজনও ভেস্তে যায় একই কারণে। আয়োজকরা অভিযোগ করেছেন, একদল লোকের দাবির মুখে তারা অনুষ্ঠানগুলো বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
নাট্য উৎসব বন্ধের পেছনে কী ছিল?
শনিবার বিকাল পাঁচটায় ঢাকার মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ‘ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব’ উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় আয়োজকরা জানান, কিছু লোক অনুষ্ঠান নিয়ে আপত্তি তোলে এবং হামলার হুমকি দেয়। ফলে সব প্রস্তুতি থাকার পরও তারা অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
ঢাকা মহানগর নাট্য পর্ষদ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দুই মাস ধরে ৮৫টি নাট্যদলের কর্মীরা এই উৎসবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির কর্মকর্তারা আয়োজকদের জানান, রমনা থানা থেকে ফোন করে উৎসব বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
এরপর আয়োজকরা থানার ওসির সঙ্গে দেখা করেন এবং নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন জমা দেন। তবে আয়োজকদের দাবি, থানার ওসি তাদের আশ্বস্ত করলেও ‘একটি নাটক বাদ দিতে’ বলেন।
উৎসব উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব কামাল আহমেদ বলেন- “ওসি সাহেব বলেন, আমরা চাই উৎসব হোক, কিন্তু একটা নাটক বাদ দিতে হবে। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটক বাদ দিতে হবে। কেন এই নাটক বাদ দিতে হবে, তা আমাদের স্পষ্ট নয়। মনে হয়েছে, তিনি কোথাও থেকে নির্দেশনা পেয়েছেন।”
তবে আয়োজকরা জানান, উৎসবটি একটি দলকে বাদ দিয়ে আয়োজন সম্ভব নয় বলে তারা নাট্য উৎসব ‘অস্থায়ীভাবে স্থগিত’ করেন।
থানা থেকে বের হওয়ার পরপরই একটি ‘মব’ থানায় ঢুকে আয়োজকদের ওপর ধমক-গালাগাল করে এবং মহিলা সমিতির কর্মকর্তাদের উপর চাপ দেয়। ফলে মহিলা সমিতি রাতে হল বরাদ্দ বাতিল করে।
পুলিশের দাবি: উৎসব বন্ধের নির্দেশনা দেইনি
শনিবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এক বিবৃতিতে জানায়- “আমরা নাট্যোৎসব বন্ধ বা স্থগিত করার কোনো নির্দেশনা দেইনি। যেকোনো সৃজনশীল ও শৈল্পিক কর্মকাণ্ডকে আমরা সবসময় উৎসাহিত করে থাকি। নাট্যোৎসব স্থগিতের কারণ আমাদের বোধগম্য নয়।”
এদিকে আয়োজকরা অভিযোগ করেছেন, শুক্রবার রাতেই কে বা কারা মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তন থেকে উৎসবের সাজসজ্জা খুলে নিয়ে যায়।
নাট্যকর্মীদের দাবি, “এটি নতুন কিছু নয়। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতেও একটি নাট্যদলের শো মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিবাদে নাট্যকর্মীরা সমাবেশ করলে তাদের ওপর হামলা করা হয়। আজকের ঘটনাও তারই পুনরাবৃত্তি।”
বসন্ত উৎসব বন্ধ হয়ে গেল কেন?
১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় বসন্ত উৎসব আয়োজনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও শেষ মুহূর্তে স্থানীয় একদল লোক বাধা দেয়।
জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট জানান, “প্রথমে তারা বলল, মঞ্চের নাম বদলাতে হবে। আমরা তা মানলাম। পরে বলল, আয়োজকদের তারা পছন্দ করে না। তারপর রাত ১২টা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আলোচনা করেও কোনো সমাধান হয়নি। বাচ্চাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা অনুষ্ঠান স্থগিত করি।”
স্থানীয় এক ব্যক্তির নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। তবে জাতীয় নাগরিক কমিটির উত্তরা জোন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা কোনো অনুষ্ঠান বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে না।
চট্টগ্রামের বসন্ত উৎসবেও বাধা
চট্টগ্রামের সিআরবি মাঠে আবৃত্তি সংগঠন প্রমা বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছিল। সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠান চললেও দুপুরের অধিবেশন শুরুর আগেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ হঠাৎ অনুমতি বাতিল করে।
প্রমার সভাপতি রাশেদ হাসান বলেন- “দুপুরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানালো, আমরা অনুষ্ঠান করতে পারবো না। পরে লিখিত চিঠিও দিয়েছে।”
তবে কী কারণে অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে, তা আয়োজকদের জানানো হয়নি।
লালন স্মরণোৎসবও স্থগিত
টাঙ্গাইলের মধুপুরে হেফাজতে ইসলাম ও কওমী ওলামা পরিষদের আপত্তির মুখে লালন স্মরণোৎসবও বন্ধ হয়ে যায়।
আয়োজক মো. সবুজ মিয়া বলেন- “তারা ইউএনওকে লালনের গানের কিছু স্ক্রিনশট দেখিয়ে বলেছে, এই ধরনের গান শিরক বা কুফরি। আমরা মধুপুরে এটি চলতে দেব না।”
তবে পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মধ্যস্থতায় সমঝোতার ভিত্তিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
কেন বন্ধ হচ্ছে একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান?
সাম্প্রতিক সময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো একের পর এক বাধার সম্মুখীন হওয়ায় নাগরিক সমাজের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন- “এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ধারাবাহিক ঘটনা। আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর আঘাত করা হচ্ছে। একটি বিশেষ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এগুলো করছে।”
তার মতে, সরকারের নীরবতা এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাই এসব ঘটনার কারণ। তিনি আরও বলেন- “রাষ্ট্র যদি এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ধীরে ধীরে থমকে যাবে।”
দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মীরা মনে করছেন, যদি এই ধরনের বাধা অব্যাহত থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা হুমকির মুখে পড়বে।