BMBF News

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এখন ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’

বাংলা নববর্ষের বর্ষবরণের অন্যতম আকর্ষণীয় আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম এবার থেকে আর থাকছে না। পরিবর্তে এই শোভাযাত্রার নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই নাম পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ জানান, এবার শোভাযাত্রার নাম রাখা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আমি ‘পরিবর্তন’ বলতে চাই না। শুরুতে বর্ষবরণ ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। আগে যেভাবে হয়েছিল সেটির স্বতঃস্ফূর্ততা কতখানি ছিল সেটা বিশ্লেষণের বিষয়। পরবর্তীতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র ক্ষেত্রে কী ঘটেছে, এজন্য এটিকে পরিবর্তন নয়, পুনরুদ্ধার বলছি আনন্দ শোভাযাত্রাকে।”

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরের শোভাযাত্রাটি হবে “সর্ববৃহৎ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ।” শোভাযাত্রায় থাকবে বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন জাতিসত্তার অংশগ্রহণ।

চারুকলা অনুষদের ডিন জানান, এবারের ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শোভাযাত্রায় অংশ নেবে বাংলাদেশে বসবাসরত ২৮টি জনগোষ্ঠী। সবার অংশগ্রহণে এই শোভাযাত্রাটি ‘সকলের হয়ে উঠবে’ বলে আশাবাদী আয়োজকরা।

এবারের নববর্ষের শোভাযাত্রা আয়োজনের শুরু থেকেই ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। তখন থেকেই শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। অবশেষে নতুন বছর শুরুর তিন দিন আগে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই নাম পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হলো।

এ প্রসঙ্গে চারুকলা অনুষদের ডিন ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ বলেন, “গেল সময়ে ‘মঙ্গল’ শব্দটিকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যেটা নিয়ে যথেষ্ট খারাপ অনুভূতি কাজ করছে। তাই আমরা অতীতে ফিরে যেতে চাই যেখানে সকল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। সেখানে সংস্কৃতিতে কোনো রাজনৈতিক আগ্রাসন ছিল না।”

এর আগে, গত ২৩শে মার্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তখন তিনি বলেন, নাম নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে শোভাযাত্রার আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

চারুকলা অনুষদ থেকে সংবাদ সম্মেলনের জন্য গত ৮ই এপ্রিল যে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়, সেখানে কেবল ‘শোভাযাত্রা’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নয়।

এবারের শোভাযাত্রার মোটিফ হিসেবে ‘স্বৈরাচারের’ দৈত্যরূপের প্রতিকৃতি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই বলছেন, এটি ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবয়ব অনুকরণে তৈরি করা হচ্ছে।

এছাড়াও বড় আকৃতির ইলিশ মাছ, কাঠের বাঘ, শান্তির পায়রা, ঘোড়া, পাখি, পালকি, মুগ্ধর পানির বোতল, ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে তরমুজের ফালি, সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, রঙিন চরকি, তালপেতার সেপাই, পটচিত্র ইত্যাদি মোটিফ থাকবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন।

তারা বলেন, তরমুজ ফিলিস্তিনিদের কাছে “প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের প্রতীক।” ফলটির বাইরের অংশ সবুজ, ভেতরের অংশ লাল, সাদা ও কালো—যা ফিলিস্তিনের পতাকার রঙের সঙ্গে মিল রাখে। তাই এবারের শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনের সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানিয়ে তরমুজের মোটিফ রাখা হচ্ছে।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে ‘অমঙ্গল’কে দূর করে ‘মঙ্গলের’ আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নাম রাখা হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে এই শোভাযাত্রা শুরু হয়।

শোভাযাত্রায় নানা প্রতিকৃতি প্রদর্শিত হয়, ঢাক-বাদ্য বাজিয়ে সেটি শাহবাগ মোড় হয়ে শিশুপার্ক ঘুরে ফের শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয়। ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর ইউনেসকো এই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে।

তবে এবারের শোভাযাত্রা চারুকলার সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ গোলচত্বর ঘুরে টিএসসিতে রাজু ভাস্কর্য ডানে রেখে শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে আবার চারুকলায় এসে শেষ হবে।

এতে সমতল ও পাহাড়ি এলাকার মানুষ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ব্যান্ড, বাউল, মূলধারার শিল্পীগোষ্ঠী, নারী ফুটবলার, ঘোড়ার গাড়ি, রিকশার র‍্যালি অংশ নেবে। সম্মুখভাগে থাকবে পুলিশ বাহিনীর আটটি সুসজ্জিত ঘোড়ার সারি।

র‍্যালি চলাকালে বাংলা মোটর, বারডেম হাসপাতাল, আজিজ সুপার মার্কেট ও মৎস্য ভবন এলাকার সড়ক বন্ধ থাকবে। নীলক্ষেত ও পলাশীর দিক খোলা থাকবে। শোভাযাত্রা শেষে সড়কগুলো খুলে দেওয়া হবে।

নিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শোভাযাত্রার দুই পাশে অবস্থান নেবে। নিরাপত্তা ও ভিড় নিয়ন্ত্রণে মেট্রোর টিএসসি স্টেশন বন্ধ রাখা হবে শোভাযাত্রাকালীন সময়। বিকেল ৫টার পর ক্যাম্পাসের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যাবে, তবে বের হয়ে যাওয়ার পথ খোলা থাকবে।

এবারের শোভাযাত্রা আয়োজন নিয়ে চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মতবিরোধও প্রকাশ্যে এসেছে। ২৬শে মার্চ চারুকলার ২৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের (২০১৭-১৮ সেশন) নামে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, “এবারের বৈশাখ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।” সেখানে বলা হয়, শোভাযাত্রার কাঠামোর নকশা ও ভাবনা সম্পূর্ণ শিক্ষকদের, সাধারণ শিক্ষার্থীরা এতে কোনোভাবেই জড়িত নয়।

তবে চারুকলার ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম শেখ বিবৃতিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “যারা এই বিবৃতি দিয়েছে তারা চারুকলার বর্তমান ছাত্র না, পাস করে গেছে।” তার মতে, “১৯৮৯ সাল থেকে শিক্ষক, সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন হতো। ২০০৬ সাল থেকে একটি ব্যাচকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে এবার সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মতামতের ভিত্তিতে আবারও সবাইকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “কোনো একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে যারা এটা করেছে। যারা বিবৃতি দিয়েছে তাদের ব্যাচেরও তো অনেকে এসে কাজ করছে। তাহলে এটা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না? বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামকে বিতর্কে ফেলে দেওয়ার মতো উদ্দেশ্যে এটা করছে সেটা বলা যায় না?”