BMBF News

মোসাদ কিভাবে ইরানের ভিতর থেকেই ড্রোন হামলা চালাতে সক্ষম?

১১

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ ইরানের ওপর যে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইরানের ভূখণ্ডের ভেতর থেকেই ড্রোন হামলা চালানো। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এই সক্ষমতা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্বের অন্যতম সুরক্ষিত দেশগুলোর একটি, ইরানের অভ্যন্তরে মোসাদ কিভাবে এত সহজে অনুপ্রবেশ করে এই ধরনের অভিযান চালাতে সক্ষম হলো?

গোয়েন্দা সক্ষমতা ও নেটওয়ার্ক:
প্রাথমিক তথ্যানুসারে, মোসাদের শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্কই এই ধরনের দুঃসাহসিক অভিযানের মূল ভিত্তি। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের সামরিক কমান্ড এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে থাকা মূল ব্যক্তিদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য কাজ করে আসছে। এর অর্থ হলো, ইরানের অভ্যন্তরে মোসাদের নিজস্ব এজেন্ট বা সহযোগী রয়েছে, যারা সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ করে ইসরায়েলের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম। এই এজেন্টরা স্থানীয়ভাবে ড্রোন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তাও দিতে পারে।

অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও অসন্তোষ:
ইরানের কঠোর শাসনব্যবস্থা সত্ত্বেও, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্তরে অসন্তোষ বিদ্যমান। এটি মোসাদের মতো বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে, যারা সরকারের বিরোধিতা করে বা ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট, তাদের মধ্যে থেকে মোসাদ সহযোগী খুঁজে পেতে পারে। এই স্থানীয় সহযোগীরা গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ, অস্ত্র বা সরঞ্জাম পাচার এবং এমনকি ড্রোন উৎক্ষেপণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও সহায়তা করতে পারে।

প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা:
মোসাদ তার প্রযুক্তিগত সক্ষমতার জন্য সুপরিচিত। অত্যাধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি, যা ছোট এবং সহজে সনাক্ত করা যায় না, তা এই ধরনের অভিযানের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। সম্ভবত, এই ড্রোনগুলো ছোট আকার এবং কম রাডার স্বাক্ষরযুক্ত, যা ইরানের উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া, ড্রোনগুলো জিপিএস-ভিত্তিক নেভিগেশন এবং রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে দূর থেকে পরিচালনা করা হয়েছে, যা ধরা পড়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে, ড্রোনগুলো ছোট এবং গোপনে পরিবহনযোগ্য হতে পারে, যা ইরানের সীমান্তের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে গোপনে স্থাপন করা সহজ করে তোলে।

ক্ষুদ্র ড্রোন এবং বিস্ফোরক:
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রাথমিকভাবে ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে, যার মধ্যে শিশুসহ বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন। মোসাদের ড্রোন হামলার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক স্থাপনা এবং আইআরজিসি-র ঘাঁটি। এই ধরনের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য ক্ষুদ্র আকারের ড্রোন ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে, যা উচ্চ-বিস্ফোরক পেলোড বহন করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম। এই ড্রোনগুলো সাধারণত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নজরদারি এড়িয়ে লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি:
মোসাদ এক রাতের সিদ্ধান্তে এই ধরনের হামলা চালায়নি। এটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির ফল। গত এক দশক ধরে ইরানের পারমাণবিক অগ্রগতিকে ধীর করতে ইসরায়েল বিভিন্ন মাত্রায় চেষ্টা চালিয়েছে, যার মধ্যে ইরানি বিজ্ঞানীদের হত্যা এবং সাইবার হামলাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সব পদক্ষেপের মাধ্যমে মোসাদ ইরানের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করেছে এবং সেগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার একেবারে কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ করে আঘাত হানতে পারার ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছে যে সেখানে কেউই আর নিরাপদ নয়।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট:
ইসরায়েল এই হামলার জন্য এমন একটি সময় বেছে নিয়েছে যখন ইরান বিভিন্ন দিক থেকে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। লেবানন, সিরিয়া ও গাজায় তাদের সমর্থক ও মিত্রদের কার্যকর পরাজয় বা নির্মূল হওয়ার ফলে ইরান ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এছাড়া, ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গত অক্টোবরে ইসরায়েলের হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মোসাদ তার অভিযান পরিচালনা করেছে।

মোসাদের ইরানের ভেতর থেকে ড্রোন হামলা চালানোর সক্ষমতা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চতর দক্ষতা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং সম্ভবত ইরানের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা বা অসন্তোষকে কাজে লাগানোর প্রমাণ। এই ঘটনা কেবল ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতাই তুলে ধরেনি, বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করেছে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সংঘাতের ইঙ্গিত বহন করছে।