পাকিস্তানে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবানের (টিটিপি) হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে সেনা অভিযানে নিহত হয়েছেন বাংলাদেশি তরুণ ফয়সাল হোসেন (২২)। অথচ তার পরিবার জানত, তিনি দুবাইয়ে কর্মরত একজন প্রবাসী। দুই বছর আগে দুবাই যাওয়ার কথা বলে বাড়ি ছাড়া ফয়সালের এই পরিণতির খবরে তার গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
ফয়সাল মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ছোট দুধখালী এলাকার আবদুল আউয়াল মোড়লের ছেলে। তার পরিবার রাজধানীর জগন্নাথপুর এলাকার আজিজ সড়কে বসবাস করে।
গত শুক্রবার রাতে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কারাক জেলায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে ১৭ জন টিটিপি সদস্য নিহত হন, যাদের মধ্যে ফয়সালও ছিলেন। রোববার দুপুরে ফয়সালের বড় ভাই আরমান মোড়ল তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হন।
সোমবার সকালে ফয়সালের গ্রামের বাড়ি ছোট দুধখালীতে গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ঢাকা থেকে ভোরে রওনা হয়ে বেলা ১১টার দিকে বাড়িতে পৌঁছান ফয়সালের মা চায়না বেগম (৪৫)। তখনও তিনি ছেলের মৃত্যুর খবর জানতেন না; তাকে বলা হয়েছিল ফয়সাল দুবাইতে অসুস্থ। বাড়িতে পৌঁছানোর পর ফয়সালের নানা জয়নাল ব্যাপারী তাকে মৃত্যুর খবরটি দিলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার আহাজারিতে আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
কান্নায় ভেঙে পড়ে চায়না বেগম বলেন, ‘দুই মাস আগে ছেলের সঙ্গে কথা হলো। বলল, “মা, আমি এখানে খুব ভালো আছি।” আমি বললাম, “বাবা, তুমি দেশে চলে আসো।” সে আসবে বলেও আর এলো না। ও খালি বলত, দেশে কাজ নেই, দুবাই যাবে। পরে একদিন কাউকে না বলে চলে যায়। এক মাস পর ফোন করে জানায়, সে দুবাই আছে। আমরা তো জানতামই না ও পাকিস্তান গেছে!’
ফয়সালের পরিবার জানায়, তিনি ঢাকার কালাচাঁদপুর এলাকার একটি স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। এরপর ঢাকার বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে তসবি, জায়নামাজ, আতর ও টুপির ভ্রাম্যমাণ দোকান চালাতেন।
ফয়সালের চাচা আবদুল হালিম জানান, ‘দুই বছর আগে ফয়সাল নিখোঁজ হয়। পরে ফোন করে জানায় সে দুবাই আছে। কিন্তু দুই মাস আগে মাদারীপুর শহর থেকে পুলিশ এসে আমাদের জানায়, ফয়সাল দুবাই নয়, পাকিস্তানে আছে। আমরা তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও পারিনি।’
ফয়সালের দাদা শুক্কুর মোড়ল বলেন, ‘আমার নাতি খুব ভালো ছিল, এক ওয়াক্ত নামাজও ছাড়ত না। কারা আমার নাতিকে এই ভুল পথে নিয়ে গেল, তাদের বিচার চাই।’
ফয়সালের মৃত্যুর খবরটি প্রথম সামনে আনে অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডিসেন্ট’। গণমাধ্যমটির সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির বলেন, ‘পাকিস্তানভিত্তিক সাংবাদিক জাওয়াদ ইউসুফ তার টুইটার অ্যাকাউন্টে নিহত বাংলাদেশির ছবি প্রকাশ করেন। আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং বাংলাদেশে ফয়সালের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হয়েছি।’
দ্য ডিসেন্টের তথ্যমতে, গত এক বছরে পাকিস্তানে টিটিপির হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে অন্তত চারজন বাংলাদেশি তরুণ নিহত হয়েছেন।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অনুসন্ধান) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘পাকিস্তানে জঙ্গি হামলায় মাদারীপুরের এক তরুণের মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি। তার পরিবার আইনগত সহায়তা চাইলে আমরা সবরকম সহযোগিতা করব। যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে তরুণদের জঙ্গিবাদে উৎসাহিত করছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে।’
ফয়সালের পরিবার ও এলাকাবাসী তার লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার এবং যারা তাকে এই পথে প্ররোচিত করেছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের দাবি জানিয়েছে।