BMBF News

আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কি?

২০২৫ সালের নভেম্বরে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারিত হয় ফিসফিস করে, গোপন বৈঠকে বা বিদেশি মিডিয়ার পাতায়। একসময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী এই দলটি আজ সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ, নিবন্ধনহীন এবং তার প্রতিষ্ঠাতা নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর। তবু তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী দাবি করেন, দলটি মরেনি শুধু লুকিয়ে আছে। প্রশ্ন হলো, এই লুকোচুরি কতদিন চলবে এবং কোন রূপে তারা আবার আলোতে আসবে?

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে দলের ওপর যে ধারাবাহিক আঘাত এসেছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। প্রথমে পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ নেতৃত্ব, তারপর হাজার হাজার নেতাকর্মীর গ্রেপ্তার, সম্পদ জব্দ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ এবং অবশেষে মে ২০২৫-এ পুরো দলকে নিষিদ্ধ করা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ১৭ নভেম্বরের রায় শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, এটি দলের রাজনৈতিক মৃত্যুদণ্ডের সমতুল্য।

বাস্তবতা আরও কঠিন। নির্বাচন কমিশন দলের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন (সম্ভবত ২০২৬-এর প্রথমার্ধে) আওয়ামী লীগ নামে বা তার ব্যানারে অংশ নিতে পারবে না। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ, ফেসবুক পেজ ডিলিট, ওয়েবসাইট ব্লক। যারা এখনো দেশে আছেন তারা গা ঢাকা দিয়ে আছেন বা কারাগারে।

তবু দলটি পুরোপুরি মরেনি। ভারতে নির্বাসিত শেখ হাসিনা নিয়মিত ভিডিও বার্তা পাঠান, দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তৃণমূলে গোপন বৈঠক, ছোট ছোট গ্রুপে সংগঠন শক্ত করার চেষ্টা চলছে। অনেকে বলছেন, এটি ১৯৭৫-এর পরের আওয়ামী লীগের মতো- তখনও দল নিষিদ্ধ ছিল, নেত্রী জেলে-নির্বাসনে, কিন্তু ১৯৮১-এ শেখ হাসিনা ফিরে এসে দলকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে যান।

বিশ্লেষকরা তিনটি সম্ভাব্য পথ দেখছেন। প্রথমত, নতুন নামে নতুন দল গঠন। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদী প্রতীক্ষা। যদি অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়, অর্থনীতি ধ্বসে, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, তাহলে মানুষ আবার পুরোনো পরিচিত মুখের দিকে তাকাতে পারে। তৃতীয়ত, সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনা, দলটি ক্রমশ বিভক্ত হয়ে ছোট ছোট গ্রুপে পরিণত হবে, যেমনটা হয়েছিল এরশাদ-পরবর্তী জাতীয় পার্টির সঙ্গে।

ভারতের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। দিল্লি শেখ হাসিনাকে ফেরত দিচ্ছে না এবং গোপনে দলের কিছু নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলে অভিযোগ আছে। যদি কোনোদিন ভারত চাপ দেয় বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় “অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন” এর জন্য জোর দেয়, তাহলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হতে পারে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কঠোর, তারা বলছে, আওয়ামী লীগকে আগের রূপে ফিরতে দেওয়া হবে না।

সবচেয়ে বড় বাধা জনরোষ। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে যে হাজারো তরুণ প্রাণ হারিয়েছে, তাদের পরিবার এবং সমাজের বড় অংশ এখনো আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত নয়। যতদিন এই রক্তের দাগ না মোছে, ততদিন দলের প্রকাশ্য ফেরা কঠিন। শেখ হাসিনা বা তার উত্তরসূরিরা যদি কখনো সত্যিকারের অনুশোচনা প্রকাশ করেন, ক্ষমা চান তবেই হয়তো কিছুটা পথ খুলবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো দল চিরকালের জন্য শেষ হয় না। এরশাদের এনডিপি, জিয়ার বিএনপি সবাই ফিরেছে। আওয়ামী লীগও ফিরবে, প্রশ্ন শুধু কতদিন লাগবে আর কোন রূপে। হয়তো দশ বছর পর একটা নতুন প্রজন্মের হাতে, নতুন নামে, নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু শেখ হাসিনা-কেন্দ্রিক যে আওয়ামী লীগ আমরা চিনি, সেই দলটির সময় প্রায় শেষের দিকে।