গত ২০ আগস্ট দুপুরে ফেনী জেলায় যে বন্যা শুরু হয়েছিল, তা দ্রুত ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পরশুরাম, ফুলগাজী, ও ছাগলনাইয়া উপজেলা প্রথমে আক্রান্ত হলেও পরে বন্যার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলায়। এ বন্যায় জেলায় ২৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসন, এবং প্রায় ১১ লাখ মানুষ এবং ৯৫ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব খাতেই – কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, এবং বসতবাড়ি – ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় ৮ হাজার ৯৫টি কাঁচা ঘর ও ২৫০টি আধাপাকা ঘর সম্পূর্ণ ধসে যায়, যার ক্ষতি আনুমানিক ১৬৩ কোটি টাকা। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৩ হাজারেরও বেশি ঘর, যার ফলে মোট ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৫৩৩ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য প্রশাসন ২০ হাজার বান্ডেল টিন এবং ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে মন্ত্রণালয়ের কাছে। জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৪০০ বান্ডেল টিন ও নগদ ১২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
ফেনীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, ছয় উপজেলায় কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫২৪ কোটি টাকা, যাতে প্রায় দুই লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যার কারণে ৩০ হাজারের বেশি হেক্টর ফসলি জমি আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে আমন বীজতলা, আমন ও আউশ ধান, সবজি, ফলবাগান, এবং মসলা জাতীয় ফসল অন্তর্ভুক্ত। প্রান্তিক কৃষক আবদুল খালেক অভিযোগ করেন, তিনি কৃষি অফিসের সাথে বারবার যোগাযোগ করেও কোনো সহায়তা পাননি।
জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় প্রাণিসম্পদ এবং মৎস্য খাতের ক্ষতি প্রায় ৫৭৫ কোটি টাকা। মৎস্য খাতে জেলায় ৭৯৩ জন চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এবং অক্টোবর মাসে কিছু চাষীদের মাঝে পোনামাছ বিতরণ করা হয়েছে। খামারি ফখরুল ইসলাম মাসুক জানান, বন্যার কারণে তার মুরগির খামারে দেড় কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। খামার চালু করতে গেলেও নগদ অর্থের সংকটে আছেন তিনি।
বন্যার কারণে জেলার ৯২০টি স্কুল, মাদ্রাসা, এবং কলেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ কোটি টাকা। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজনীয় নতুন বইয়ের বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠানো হলেও এখনো বই পাওয়া যায়নি। ফুলগাজী উপজেলার বন্দুয়া দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইলিয়াছ মামুন জানান, শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য ধার করতে হলেও এখনো বরাদ্দ মেলেনি। ইউনিসেফ ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় কিছু বই বিতরণ করলেও, অন্যান্য উপজেলায় সহায়তা বিতরণ ধাপে ধাপে করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।
বন্যায় সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট, এবং বাঁধের ক্ষতি ৯২৮ কোটি টাকারও বেশি। ফুলগাজীর মুন্সিরহাট ইউনিয়নের সড়কগুলোতে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হওয়ার অবস্থা। সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছেন, সড়ক সংস্কারে কাজ চলছে এবং শিগগিরই টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সড়ক উন্নয়ন শুরু করা হবে।
ফেনী জেলার সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারি সহায়তা ও স্থানীয় সংগঠনের প্রচেষ্টায় পুনর্বাসন কার্যক্রম চলছে, তবে এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এবং ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা এখনো কঠিন চ্যালেঞ্জ।