BMBF News

ছবি দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র না করার দাবি মহিলা আনজুমানের

৩৬
নিজস্ব প্রতিবেদক :

 

জাতীয় পরিচয় পত্রের (এনআইডি) জন্য জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০২৩-এ মুখচ্ছবি বাধ্যতামূলক না করার দাবি জানিয়েছে রাজারবাগ দরবার শরাফের মহিলা আনজুমান। সোমবার (১৯ জুন) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কাছে এ দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এনআইডি নির্ভুলভাবে শনাক্ত করার জন্য ফিঙ্গার ও আইরিস-ই যথেষ্ট। মুখচ্ছবিকে পুঁজি করে বরং অপরাধ ও দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি হয়। এ জন্য তারা এনআইডিসহ রাষ্ট্রের সকল স্থানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহারের দাবি জানান।

সংবাদ সম্মেলনে আনজুমানের মুখপাত্র শারমিন ইয়াসমিন লিখিত বক্তব্যে বলেন, গত ১২ জুন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০২৩-এর খসড়ার অনুমোদন হওয়াকে কেন্দ্র করে আজ আমরা এ দাবি জানাচ্ছি।

পর্দানশীন নারীদের রাষ্ট্রীয় নিবন্ধনে আসতে চাওয়া জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করে বলা হয়, ‘শুধু মুখচ্ছবি দিতে সম্মতি না দেওয়ায় এনআইডি বঞ্চিত হয়ে আছেন অসংখ্য নারী, যারা সরকারের নিবন্ধনের আওতার সম্পূর্ণ বাইরে। অথচ সরকারি ডাটাবেজে সকল নাগরিকের নিবন্ধন থাকা জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু পর্দানশীন নারীরা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে সরকারি নিবন্ধনের আওতায় আসতে ইচ্ছুক, তাই বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। এক্ষেত্রে ছবি বাধ্যতামূলক না করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডাটা নিয়েই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে তাদের সাদরে জাতীয় নিবন্ধনের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া।

পরিচয় যাচাইয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট অনেক বেশি জননিরাপত্তা বান্ধব ও দুর্নীতিরোধক বলে বক্তব্যে বলা হয়। মুখপাত্র বলেন, বর্তমানে এনআইডিতে ব্যক্তির একটি মুখচ্ছবি থাকে, যার কার্যকারিতা নিরাপত্তার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ।

প্রথমত অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছবির সঙ্গে বাস্তব চেহারার অনেক অমিল থাকে। ফলে ছবি দেখে যাচাইয়ে বেশ বেগ পেতে হয়।

দ্বিতীয়ত দুই ব্যক্তির চেহারার মিলকে কাজে লাগিয়ে একজনের এনআইডি অন্যজন ব্যবহার করে বহুবিধ অপরাধ করে। আবার মুখচ্ছবি দেখে যাচাই পদ্ধতিকে পুঁজি করে ক্ষণস্থায়ী, গলাকাটা ও ভুয়া এনআইডি ব্যবহারও বাড়ছে। এসব কারণে বর্তমানে শুধু ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করেই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এনআইডি নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা হচ্ছে, যেখানে মুখচ্ছবির কোনো ব্যবহার নেই।

যেমন- দ্বৈত ভোটার যাচাই, রোহিঙ্গা যাচাই, ইভিএম-এ ভোট দেওয়া, সিমকার্ড নিবন্ধন ইত্যাদি। অর্থাৎ ফিঙ্গারপ্রিন্টের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সর্বজন স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। এ কারণে শুধু জাতীয় পরিচয় শনাক্তকরণেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর ব্যবহার যথেষ্ট নয়, বরং রাষ্ট্রের সকল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ফিঙ্গারপ্রিন্টের বহুল ব্যবহার চালু করা এখন সময়ের দাবি।

বিশেষ করে, একজনের হাজিরা অন্যজন দিয়ে দেওয়া চেহারা মিল থাকায় পরীক্ষার হলে প্রশ্ন দেওয়া, একজনের ত্রাণ অন্যজন চুরি করা, স্কুলে বাচ্চাদের দুপুরের খাবার আরেক জন খেয়ে নেওয়াসহ বহুবিধ দুর্নীতি ও অপরাধ বর্তমানে অহরহ ঘটছে। যা রুখতে একমাত্র সমাধান হচ্ছে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম শনাক্ত করা।

শুধু মুখচ্ছবি দিতে সম্মতি না দেয়ায় নারীদের এনআইডি থেকে বঞ্চিত করে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন বলেও অভিযোগ করেন তারা। বর্তমানে রাষ্ট্রের ২২টি মৌলিক ও নাগরিক অধিকার পেতে এনআইডির প্রয়োজন। কিন্তু শুধু মুখচ্ছবি দিতে সম্মতি না দেওয়ায় লাখ লাখ নারীকে এনআইডি থেকে বঞ্চিত করে তাদের ২২টি মৌলিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

সংবাদ সম্মেলনে তারা বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন

 

ঠিক কত সংখ্যক নারী এনআইডি বঞ্চিত:

ঠিক কত সংখ্যক নারী এনআইডি থেকে বঞ্চিত তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি। তবে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, এনআইডি প্রাপ্তির আগের ধাপ হচ্ছে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া। ২০০৮ সালে ভোটার তালিকায় পুরুষের থেকে নারীর সংখ্যা ১৪ লাখ বেশি ছিল। কিন্তু ২০২৩ এ এসে নারীর সংখ্যা পুরুষের থেকে ১৭ লাখ কমে গেছে। অথচ বর্তমান জনশুমারিতে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। নির্বাচন কমিশন নিজেও স্বীকার করেছে ধর্মীয় কারণে ছবি তুলতে না চাওয়ায় ভোটার তালিকায় নারীর অন্তর্ভুক্তি কম। ফলে তারা এনআইডি পাচ্ছেন না।

বিপুল সংখ্যক নারীকে এনআইডির আওতায় না আনতে পারার ব্যর্থতার দায় ইলেকশন কমিশনের:

দেশের বিপুল সংখ্যক নারীকে এনআইডির আওতায় আনতে না পারার ব্যর্থতার দায় সম্পূর্ণ ইসির। বিশেষ করে ‘পর্দানশীন নারীদের সমস্যা হচ্ছে এ কথা জানার পরও বিষয়টি সমাধানে উদ্যোগী হয়নি ইসি, বরং প্রতিনিয়ত উপেক্ষা করে গেছে। মূলত, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পর্দানশীন নারীদের উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের আইনসমূহে কখনই পর্দানশীন নারীদের উপেক্ষা করা হয়নি, বরং সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। যেমন, গ্রাম আদালত আইন, ভূমি রেজিষ্ট্রেশন বিধিমালা, ফৌজদারি কার্যবিধি, মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইন, বিধবা ভাতা, অবসর ভাতা গ্রহণ, বয়স্ক ভাতা গ্রহণ ইত্যাদিতে পর্দানশীন নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে। কিন্তু এনআইডির ক্ষেত্রে পর্দানশীন নারীদের কেন উপেক্ষা করা হলো, তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। ছবিবিহীন এনআইডি অনেক দেশেই স্বীকৃত। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আমিশ ও মেনোনাইয় উপদলটি প্রাণীর ছবি তোলাকে ধর্মবিরোধী বলে বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাস থেকে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল ছবিবিহীন এনআইডি কার্ডের জন্য। ২০১৯ সালে ভার্জিনিয়া সরকার তাদের দাবি পূরণ করে ছবিবিহীন এনআইডির সুযোগ করে দেয়। পাকিস্তানও নারীদের প্রাইভেসির কারণে ২০০৭ সালে এনআইডি কার্ডে নারীদের ছবি দেখার বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়। কানাডার ব্রিটিশ কলোম্বিয়া রাজ্যেও ছবিবিহীন এনআইডি কার্ডের প্রচলন আছে। সুতরাং এতো কিছুর পরও পর্দানশীন নারীদের এনআইডি থেকে বঞ্চিত করে রাখার আর কোনো অজুহাত থাকতে পারে না। এ ছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল যেখানে নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন, এনআইডিতে কোটি কোটি ভুল রয়েছে। সেখানে প্রাইভেসি ও ধর্মীয় কারণে একটি মাত্র ডাটা (ছবি) বাধ্যতামূলক না থাকলে কি অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে ? এই প্রশ্ন মহিলা আনজুমানের।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আশাবাদি পর্দানশীন নারীরা:

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যেহেতু নতুন পরিচয় নিবন্ধন আইনে এনআইডির দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে যাচ্ছে, তাই মহিলা আনজুমান আশাবাদি যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্দানশীন নারীদের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে এবং তাদের ধর্মীয় অধিকার অক্ষুন্ন রেখেই এনআইডি সুবিধা প্রদান করবে।

এ সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কাছে মহিলা আনজুমান ৩টি দাবি করেছেন:

১। প্রস্তাবিত পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০২০-এ যেন এনআইডির জন্য মুখছবি বাধ্যতামূলক করা না হয়।

২। শুধু এনআইডি নয়, রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে যেমন অফিস-আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা পরীক্ষার হলে অপরাধ, দুর্নীতি ও প্রক্সি রুখতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে শনাক্তকরণ/হাজিরা চালু করা হোক।

৩। প্রয়োজনে কোনো নারীর চেহারা দেখাসহ কোনো সহযোগিতা যদি প্রয়োজন হয়, তবে পৃথক স্থানে নারীকে নিয়েই নারীর সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হোক।