BMBF News

দুমকিতে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে একসময়ের জনপ্রিয় লাল ডাক বাক্স

মেহেদী হাসান, পটুয়াখালী প্রতিনিধিঃ

 

 

পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন পোস্ট অফিসের সামনে স্থাপিত লাল ডাক বাক্সটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় অলস বসে রয়েছে। কেউ আর এই বাক্সে কোন চিঠি ফেলে না। আধুনিকতার ছোঁয়া ও প্রযুক্তির কারণে সবকিছুই পাল্টে গেছে। ফলে তাদের বিবর্তনে ডাক বাক্স গুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন আর ডাক পিয়ন এর কোন হাক ডাক নেই। “চিঠি দিও প্রতিদিন চিঠি দিও” এক সময় গানে থাকা এই কথাগুলোই বুঝিয়ে দেয় চিঠির আবেদন জীবনের সঙ্গে ঠিক কতটা মিশে ছিল। প্রিয়জনের হাতের লেখা চিঠি কিংবা প্রিয়জনকে দেয়া চিঠি দুয়ের গুরুত্ব ছিল অনেক। কালের বিবর্তনে চিঠির আবেদন ফুঁরিয়েই গেছে। এখন আর লাল বাক্সে চিঠি জমা হয় না প্রিয়জনের জন্য। মেসেজ, ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, ভাইবারের ভিডিও কলের উপর এতটাই মানুষ মজেছে যে হাতের লেখা চিঠির আর দরকারই পড়ে না। নগর জীবনের ব্যস্ততায় হারিয়ে যেতে বসেছে চিঠির আবেদন। লাল রংয়ের ডাক বাক্স গুলো এখন পড়ে থাকে অযত্ন ও অবহেলায়। এক সময় চিঠিপত্র ছিল যোগাযোগ মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটালের ছোঁয়ায় পত্রসাহিত্য বর্তমান যুগে বিলুপ্ত প্রায়। দূরবর্তী স্বজনের কাছে জরুরি বা আবেগ তাড়িত কোন চিঠি লেখার প্রচলন প্রায় উঠে গেছে। তার বদলে মানুষের কাছে এখন প্রিয় হয়ে উঠেছে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট ভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফলে ডাক বাক্সের ব্যাবহার আর আগের মত নেই। ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে দিয়ে কবে তার প্রিয়জন সেই চিঠি পাবেন সেই অপেক্ষা এখন আর কেউ করেন না। এই বাস্তবতা শুধু পটুয়াখালীর দুমকি ডাকঘরেই নয় দেশের প্রায় প্রতিটি ডাকঘরের ডাকবাক্সের একই চিত্র। দ্রুততম যোগাযোগ মাধ্যমে এখন হাতের মুঠোয় থাকায় প্রত্যন্ত গ্রামের নববধু ও চিঠি লেখাকে সময় নষ্ট করা বলে মনে করেন। এভাবে কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জনের কাছে হাতের লেখা চিঠি আর চমক ছড়ানো ডাকবাক্সের কদর।
বর্তমানে ডাকবাক্সে সরকারি চিঠি ছাড়া আর কোন চিঠি পাওয়া যায় না। ফলে ধীরে ধীরে আবেদন হারাচ্ছে চিঠি নিয়ে রচিত আবেগ তাড়িত সব গান কবিতা সিনেমা গুলো।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পটুয়াখালীর দুমকি প্রধান পোস্ট অফিসের সামনের ডাকবাক্সটি। লেবুখালী ইউনিয়নের ভাড়ানি ব্রিজের নিচে উত্তর পার্শ্বে অত্যন্ত জবুথবু হয়ে অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে কাংখিত লাল ডাক বাক্সটি। এক সময় দেশে যোগাযোগের বাহন ছিল চিঠিপত্র আদান প্রদান আর এ কাজটি করত ডাক বিভাগ। জরুরী প্রয়োজনে অফিস আদালত প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সামাজিক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ডাক বিভাগের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগের অতি প্রাচীন এই মাধ্যমটি হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য। ডাক বাক্স, পোস্ট মাস্টার, আর ডাক পিয়নের সেই সোনালী অতীত আর সমাজ ব্যবস্থায় নেই। যদিও এই ডাক বিভাগ আজও তার ঐতিহ্য ও প্রয়োজনীয়তাকে ধারণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগাযোগ মাধ্যমের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এনালগ প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই কমছে, বাড়ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার। কালের বিবর্তনে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভাবন হওয়ায় এখন দরকারি যোগাযোগ বা আপন জনের কোন খবরের জন্য ডাক প্রিয়ন’এর পথ চেয়ে বসে থাকতে হয় না। প্রিয়জন পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন উন্নত প্রযুক্তির বদৌলতে মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনো ধরনের যোগাযোগ খুবই সহজ এবং মানুষের হাতের নাগালে এসে গেছে। ৮০ থেকে ৯০ দশকে ফ্যাক্স এর মাধ্যমে চিঠি পত্রের আদান প্রদান করা হলেও বর্তমানে ইমেইল বহুবিধ ব্যবহারে ফ্যাক্স ব্যবহার দিন দিন কমছে। অল্প সময়ের মধ্যে আর্থিক লেনদেন আর দুঃসাধ্য নয়, খুব সহজে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে এখন তা হাতের মুঠোয় বলা যায়। ডাক ব্যবহারের সময় মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হতো। তবে ডাক বিভাগের আদলে বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম কুরিয়ার সার্ভিস। ডাক যোগাযোগের অনেক কাজ যেমন চিঠিপত্র, মালামাল পরিবহন এখন এই মাধ্যমে দেশ-বিদেশে পাঠানো অনেক সহজ, যদিও তা কিছুটা ব্যয়বহুল। পোস্ট মাস্টার ও পিয়ন নিয়ম করে ডাকঘরে আসেন, তবে কাজ না থাকায় কাটাতে হয় অলস সময়। হবে নাই বা কেন? কেউ এখানে আর চিঠি পাঠাতে আসে না, মানি অর্ডার করতেও আগমন ঘটে না কারো। ৪০ কিংবা ৫০ বছর আগে চিত্রটা কিন্তু এরকম ছিল না। তখন মানুষের আনাগোনা ও ডাক পিয়নের হাক ডাকে সরগরম থাকতো সারাদিন। লাইন ধরে কেউ টাকা জমা দিতেন, কেউবা আবার টাকা নিতেন। অনেকে আবার আসতেন প্রিয়জনের কাছে চিঠি পাঠাতে। সরকারিভাবে কিছু চিঠি পত্র অবশ্যই এখনো আছে এ ঠিকানায়। বিভিন্ন ধরনের গেজেট বা সরকারি প্রজ্ঞাপন, কখনো বা সরকারি চালান চিঠিপত্র বিলি করে মাসিক কাজ টিকে আছে পুরানো এই ডাকঘর। নামমাত্র ডাক বাক্স টিকে আছে, তবে তার ব্যবহার আর নেই। ডাক সংশ্লিষ্টদের মতে, বেসরকারি কোম্পানিগুলো চিঠি আদান-প্রদান আধুনিক পদ্ধতিতে নিয়ে এলেও ডাক বিভাগ এখনো পড়ে আছে সেই আগের নিয়মই। আর এ কারণেই মানুষ যোগাযোগের মাধ্যমে হিসেবে বেছে নিয়েছে কুরিয়ার সার্ভিসকে। প্রত্যাশিত সেবা না পাওয়ার ফলে ডাক সেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সবাই। ডাকঘর গুলো টিকে আছে মানি ট্রান্সফার সঞ্চয় গ্রহণসহ নানা বিকল্প সেবার মাধ্যমে। অযত্ন অবহেলায় অবিভৃত হয়ে প্রায় ডাকঘরই অকার্যকর হয়ে পরে আছে। মাসের পর মাস খোলা হয়নি এমন ডাকবাক্সের সংখ্যাও কম নয়। এ বিষয়ে দুমকি উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা প্রবাসী মিজানুর রহমান মৃধা বলেন, আগেকার দিনে হাতের লেখা চিঠি ডাকবাক্সের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়ে দূরের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। কিন্তু মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকলে চিঠি লেখা বাদ দেই। তবে বর্তমান সময়ে ছেলে-মেয়েদের চিঠিপত্র আদান-প্রদান করতে দেখা যায় না। ১০-১২ বছর আগেও বিদেশ থেকে স্ত্রীর সন্তানদের সাথে হাতে লেখা চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করতাম। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমেইলের মাধ্যমে যখন থেকে সহজে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো তখন থেকেই কমে গেল চিঠিপত্র আদান প্রদান। এতে এখন আর সাধারণ মানুষের চিঠিপত্র আগের মত আর আসে না তবে আসে শুধু সরকারি চিঠিপত্র। বর্তমানে পোস্ট অফিসে পার্সেল বীমা পরীক্ষার খাতা মোবাইল মানি অর্ডারের মত কাজগুলো হচ্ছে। আগের দিনের মতো এখন আর ব্যাপকভাবে চিঠিপত্র লেনদেন হয় না। তবে এখনো কিছু লোকজন আদান প্রদান করে থাকে।
দুমকি ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার মোঃ মজিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমানে ডাকঘরের সামনে রক্ষিত লাল ডাক বাক্সে এখন আর কেউ চিঠিপত্র ফেলে না। তাই অলসভাবে পড়ে রয়েছে এক সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বাক্সটি। তবে স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতি বছর বাক্সটিকে লাল রং দিয়ে যত্ন করে রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছি।