সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল ইরানের ওপর যে হামলা চালিয়েছে, তা এক অর্থে নজিরবিহীন। ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামক এই অভিযান, যা ইসরায়েল পরিচালনা করেছে, তার পাল্টা জবাব দিয়েছে ইরানও, ইসরায়েলের উপর হামলা চালিয়ে। গত বছর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন বিনিময় হলেও, এবারের সংঘাত অতীতের যেকোনো সংঘর্ষের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত। ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এটি ইরানের ভূখণ্ডের ওপর চালানো সবচাইতে বড় হামলা বলে মনে করা হচ্ছে।
হামলার বিবরণ ও উদ্দেশ্য:
ভোরের আলো ফোটার আগে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী শুধুমাত্র ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত স্থাপনাগুলোকেই নয়, সে দেশের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলোকেও নিশানা করে হামলা চালায়। এর ফলে ইরানের পাল্টা আঘাতের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। জানা গেছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের নেটওয়ার্ক ইরানের সামরিক কমান্ড এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছিল।
এই অভিযানে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) প্রধান, মূলধারার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং আইআরজিসি-র বিমান বাহিনীর প্রধানের মৃত্যু হয়েছে। আইআরজিসি ১৯৭৯ সালে শাহের শাসনকে উৎখাতকারী ইসলামি বিপ্লবের মূলে ছিল। ইরান জানিয়েছে, কমপক্ষে সে দেশের ছয়জন বিজ্ঞানীরও মৃত্যু হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সংবাদে ৭৮ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছে, যার মধ্যে শিশুসহ বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন। মোসাদ ইরানের ভিতর থেকেই ড্রোন হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে বলেও জানা গেছে। এই পুরো অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক স্থাপনা এবং আইআরজিসি-র ঘাঁটি। দীর্ঘ সময় ধরেই ইসরায়েল ঠিক এই কাজটাই করতে চেয়েছিল। এই হামলা ইরানকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হতে পারে এটা সূচনা মাত্র এবং ইসরায়েলের তালিকায় আরও সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু রয়েছে যেখানে আঘাত হেনে ইরানকে আরও প্রভাবিত করতে চায় তারা।
হামলার কারণ ও সময়:
ইসরায়েলের এই হামলার মূল কারণ হলো ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ সন্দেহ করে যে ইরান গোপনে “ব্রেকআউট সক্ষমতা” গড়ে তুলছে, যার অর্থ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও তা দ্রুত মোতায়েন করার ক্ষমতা। ইরান অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে তাদের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ।
গত এক দশক ধরে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক অগ্রগতিকে ধীর করতে এবং তা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মাত্রায় চেষ্টা চালিয়েছে। এর মধ্যে ছিল অজ্ঞাত আততায়ীদের হাতে ইরানি বিজ্ঞানীদের রহস্যজনক মৃত্যু, যেমন ২০২০ সালে পারমাণবিক কর্মসূচির সামরিক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফাখরিজাদেহের হত্যাকাণ্ড। এর আগে, মার্কিন ও ইসরায়েলি সাইবার গোয়েন্দারা ‘স্টাক্সনেট’ ভাইরাস ব্যবহার করে ইরানের সেন্ট্রিফিউজ সিস্টেমকে নষ্ট করে দিয়েছিল।
চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা, ‘ইন্টারন্যাশাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি’ (আইএইএ) ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করার অভিযোগ তুলে তাদের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানোর হুমকি দিয়েছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, বিশেষত সে দেশে উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ রাখাকে কেন্দ্র করে। এই ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েছে, যা বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় স্তরের চেয়ে অনেক বেশি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর ২০১৫ সালের ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন, যার ফলে পরের বছর ইরানও ওই চুক্তি মেনে চলা বন্ধ করে দেয়। ইসরায়েলের মতো ছোট দেশ, যার জনসংখ্যা ৯৫ লক্ষ, পরমাণু শক্তিধর ইরানকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে। এর কারণ হিসাবে ইরানের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের অসংখ্য বিবৃতি উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে তারা ইসরায়েলকে ধ্বংস করার ডাক দিয়েছেন। সৌদি আরব, জর্ডান ও উপসাগরীয় আরব দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন।
ইসরায়েলের জন্য এই সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেবানন, সিরিয়া ও গাজায় তাদের সমর্থক ও মিত্রদের কার্যকর পরাজয় বা নির্মূল হওয়ার ফলে ইরান ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গত অক্টোবরে ইসরায়েলের হামলার পর ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসে একজন সহানুভূতিশীল প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। এছাড়া আরও একটি বড় কারণ হলো, ইসরায়েল আশঙ্কা করেছিল, ইরান তাদের কিছু প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সরঞ্জাম ভূগর্ভের গভীরে সরাতে চলেছে।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি:
এই অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েল অন্তত ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে বছরের পর বছর পিছিয়ে দিতে চায়, এবং সম্ভব হলে পুরোপুরি বন্ধ করতে চাইবে। ইসরায়েলের সামরিক, রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা মহলের অনেকে আশা করেন, এই অভিযান ইরানের নেতৃত্বকে এতটাই দুর্বল করতে সক্ষম হবে, যাতে তারা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এবং সেখানে এমন শাসন দেখা যাবে, যা আর হুমকি সৃষ্টি করবে না।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুক্রবার বলেন, ইরান একটি চুক্তিতে সম্মত হওয়ার জন্য ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ পেয়েছে। রোববার মাস্কাটে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান ষষ্ঠ দফা আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও ইসরায়েল এই সব আলোচনাকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। ইসরায়েল আশঙ্কা করছে, ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার আঁতাতের অভিযোগের মতো, ইরানের ক্ষেত্রেও একই জিনিস হতে পারে। ইসরায়েলের মতে, ইরানের সন্দেহভাজন পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংস করার জন্য এটাই তাদের সেরা এবং সম্ভবত শেষ সুযোগ।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) সিনিয়র পলিসি ফেলো এলি গেরানমায়েহ বলেছেন, “ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে নষ্ট করার জন্যই ইরানে রাতভর নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।” তিনি মনে করেন, হামলার সময় এবং বড় আকারের প্রকৃতির উদ্দেশ্য ছিল আলোচনাকে পুরোপুরিভাবে লাইনচ্যুত করা।
ওয়াশিংটন ইরানকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, এই হামলার সঙ্গে তারা জড়িত নয়। কিন্তু ইরান যদি ওই অঞ্চলে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটির যেকোনো একটিতে সরাসরি বা প্রক্সির মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের আরও একটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইসরায়েলকে ‘কঠোর শাস্তি’ দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও দুই বছর আগের তুলনায় ইরান এখন অনেকটাই দুর্বল অবস্থানে রয়েছে এবং তাদের কাছে প্রতিশোধ নেওয়ার বিকল্পও সীমিত।
পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা:
তবে এখানে আরও বড় ঝুঁকি রয়েছে। ইসরায়েলের এই অভিযান উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে এবং পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। ইরানের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরের কট্টরপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরে এই যুক্তি দিয়ে এসেছেন যে, ভবিষ্যতে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ ঠেকাতে সর্বোত্তম প্রতিরোধ হতে পারে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা। তারা লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফি এবং উত্তর কোরিয়ার উদাহরণকে সামনে রেখেছে। গাদ্দাফি তার গণবিধ্বংসী অস্ত্র কর্মসূচি ত্যাগ করার আট বছর পর নিহত হন, যেখানে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক ওয়ারহেড এবং আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের একটি শক্তিশালী অস্ত্রাগার তৈরি করে যেকোনো সম্ভাব্য হামলাকারীকে দু’বার ভাবতে বাধ্য করেছে।
ইসরায়েলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ থেকে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যাই হোক না কেন, ইরানের শাসকগোষ্ঠী যদি টিকে থাকে – তাহলে এখন একটি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে যে তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে এবং এমনকি তা পরীক্ষা করতেও উদগ্রীব হয়ে উঠবে। যদি তা হয়, তাহলে প্রায় অনিবার্যভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে, যেখানে সৌদি আরব, তুরস্ক এবং সম্ভবত মিশর সকলেই মনে করবে তাদেরও পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজন আছে।